ঢাকা: সাভারের ধসে পড়া ভবন রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানাকে গ্রেফতারে রোববার সকাল থেকে শেষ ৬ ঘণ্টা নাটকীয়ভাবে অতিবাহিত হয়। সুচতুর রানার অবস্থান শতভাগ নিশ্চিত হওয়ার পরই তাকে টিভিতে সেই সাভারের সংবাদ দেখা অবস্থায় আটক করতে সক্ষম হয় র্যাব। আর পুরো অভিযানের নেতৃত্ব দেন র্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালক লে. কর্নেল জিয়াউল আহসান।
র্যাব সূত্রে জানা গেছে, র্যাবের গোয়েন্দা ইউনিট শুরু থেকে রানার গতিবিধির ওপর নজর রাখেন। র্যাবের সদর ইউনিটের গোয়েন্দা দলসহ প্রত্যেকটি ইউনিটের গোয়েন্দা সদস্যরা এ ব্যাপারে নজরদারি করতে থাকেন। আর সদরে বসে মনিটরিং করেন গোয়েন্দা শাখার পরিচালক লে. কর্নেল জিয়াউল আহসান।
সংবাদ মাধ্যমকে রানাকে গ্রেফতার অভিযান বর্ণনা করতে গিয়ে জিয়াউল আহসান বলেন, “রানা ঘটনার পর বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করেন। তিনি ঢাকা ছাড়াও তিন থেকে চারটি জেলায় পালিয়ে বেড়ান। সর্বশেষ রোববার সকাল বেনাপোলের বলফিল্ড এলাকায় মোজাম্মেল হক নামে এক ব্যক্তির বাড়িতে অবস্থান নেন।”
ওই বাড়িটি থেকেই গ্রেফতারের পূর্ব মুহূর্তে রানা টিভিতে সাভারের উদ্ধারকাজ দেখছিলেন বলেও জানান লে. কর্নেল জিয়াউল আহসান। তিনি বলেন, “প্রথম দিন থেকেই রানাকে আমরা টার্গেট করি। র্যাবের প্রত্যেকটি ব্যাটালিয়নকে এ ব্যাপারে সজাগ থাকার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। আর আমরা তার গতিবিধি আমাদের নজরে নেই। ২৪ এপ্রিল বুধবার রানা প্লাজা ধসের পর রানা সেখান থেকে পালিয়ে আসেন রাজধানীর মোহাম্মদপুরে শামিম নামের এক বন্ধুর বাসায়। এরপর তিনি আর মোহাম্মদপুরে থাকেনি। পরদিন ২৫ এপ্রিল বৃহস্পতিবার চলে যান মানিকগঞ্জের আফজাল শরিফ নামের আরেক বন্ধুর বাসায়। ২৬ এপ্রিল শুক্রবার পদ্মানদী পার হয়ে ফরিদপুরে বন্ধু অনিলের বাসায় গিয়ে ওঠেন। অনিল ওই দিন যশোরের ঝিকরগাছার শাহ আলমের কাছে পৌঁছে দেন রানাকে। এরপর শাহ আলমের বাড়িতে একদিন থাকার পর বেনাপোলের মনিরুজ্জামান মিঠুর বলফিল্ডের বাসায় যান রানা। সেখান থেকেই তিনি ভারতে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। এ অবস্থায় গ্রেফতার হন রানা।”
গ্রেফতার এড়াতে পারলে রোববারই রানা ভারতে চলে যেতেন বলেও জানান গোয়েন্দা বিভাগের এই পরিচালক। জিয়াউল আহসান বলেন, “আমরা তাকে নজরদারি করতে থাকি। ধাপে ধাপে তাকে পর্যবেক্ষণের আওতায় রেখেই তাকে আটক করা হয়।” সফলতার শেষ ৬ ঘণ্টার বিষয়ে র্যাব সূত্র জানায়, রোববার সকাল ৭টার দিকে র্যাবের বিভিন্ন গোয়েন্দা ইউনিটের সদস্যরা জানতে পারেন, রানা বেনোপোলে অবস্থান করছেন। এরপর শুরু হয় তার সঠিক অবস্থান নির্ণয়ের পালা। বিভিন্নভাবে খোঁজ করতে করতে জানা যায়, বলফিল্ডের মোজাম্মেল হোসেন নামের এক ব্যক্তির বাসায় অবস্থান করছেন তিনি। এরপর ওই বাড়ির চারদিকে ঘিরে ফেলে অবস্থান নেন র্যাব সদস্যরা।
এরপর ঢাকায় বসে পর্যবেক্ষণ করা গোয়েন্দা পরিচালক জিয়াউল আহসান সঙ্গীয় ফোর্স নিয়ে হেলিকপ্টারযোগে চলে যান যশোরে। এরপর তিনি নিজে নেতৃত্ব দিয়ে অভিযান পরিচালনা করে আটক করেন রানাকে। পাশাপাশি রানাকে ভারতে পালাতে সহযোগিতা করার অভিযোগে আটক করা হয় তার বন্ধু অনিল ও মনিরুজ্জামান মিঠুকে। রানাকে গ্রেফতারের পর রোববার বিকেলে র্যাব সদর দফতরে এসে এক সংবাদ সম্মেলনও করা হয়। রোববার রাতেই জিজ্ঞাসাবাদের পর গ্রেফতারকৃতদের ঢাকা জেলা গোয়েন্দা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হবে।
দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ এ ভবন ধসের ঘটনা ঘটে ২৪ এপ্রিল বুধবার। নিন্মমানের রড সিমেন্ট আর নকশা বহির্ভুতভাবে নির্মিত এ ভবনে ৫টি গার্মেন্টস, ব্যাংকসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ছিল। বুধবার সকালে অন্যান্য প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও গার্মেন্টসগুলো খোলা ছিল। ভবনটির ৩য় থেকে ৮ম তলায় ওই ৫টি গার্মেন্টস কারখানায় ৩ হাজারের বেশি শ্রমিক কর্মরত ছিলেন। বেঁচে যাওয়া শ্রমিকরা অভিযোগ করেছেন, আগের দিন ভবনে ফাটল হয় ও পিলার ধসে পড়ে। তা সত্বেও বুধবার সকালে তাদের জোর করে কারখানায় ঢোকানো ও কাজ করতে বাধ্য করা হয়।
মর্মান্তিক এই ঘটনায় প্রথম দিনই দোষীদের গ্রেফতার করার জন্য নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। এদিকে রানাসহ ৩ জন ছাড়াও এর আগে গ্রেফতার করা হয়েছে রানার স্ত্রীসহ ৪ জন আত্মীয়, ৩ জন গার্মেন্টস মালিক ও ৪ জন প্রকৌশলীসহ আরও ১১ জনকে। এ ধসের ঘটনায় রোববার দুপুর সোয়া ৩টা পর্যন্ত ৩৭৩ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩৪৮ জনের লাশ স্বজনের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। অন্য লাশগুলো হস্তান্তরের অপেক্ষায় রয়েছে। জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে দুই হাজার ৪৭৯ জনকে।
এদিকে মাত্র ক’বছরে কি করে এতো সম্পদের মালিক হলেন সোহেল রানা তা তদন্তে মাঠে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। রোববার বিকেলে এ বিষয়ে অনুসন্ধান টিম গঠন করা হয়েছে বলে সন্ধ্যায় সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন দুদক কমিশনার মো: সাহাবউদ্দিন চুপ্পু। তিনি বলেন, ‘‘সোহেল রানার স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পদের হিসাব চাইবে দুদক। রানা প্লাজাসহ বিভিন্ন ভবন নির্মাণে কিভাবে টাকা পেয়েছেন এবং পাশাপাশি বিল্ডিং নির্মাণের ক্ষেত্রে অনিয়ম ও রাজউকের কোনো অবহেলা ছিলো কি-না তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’’
দুদক জানায়, রানার অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানে কমিশন দুই সদস্যের একটি টিম গঠন করেছে। এ টিম রানার অবৈধ সম্পদ এবং বিল্ডিং নির্মাণের ক্ষেত্রে অনিয়ম তথা রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) অবহেলা সংশ্লিষ্ট বিষয়াদির অনুসন্ধান করবে। দুদকের উপ-পরিচালক মো. মফিদুল ইসলামের নেতৃত্বে টিমের অন্য সদস্য হলেন- সহকারী পরিচালক মাহবুবুল আলম।
রাজনৈতিক প্রভাব ও ক্ষমতার বলে বিভিন্ন অবৈধ ব্যবসার মাধ্যমে সোহেল রানা রাতারাতি বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক বনে যান। নামে-বেনামে তার কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ২০০৭ সালে রানা প্লাজার নির্মাণ শুরু হয়। এর আগে জায়গাটি ছিল পরিত্যক্ত। পেছনে ছিল জলাশয়। ভবন নির্মাণের জন্য এগুলো দখল করে বালু ফেলে ভরাট করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
এছাড়া সাভার বাজার রোডে রানার রয়েছে আটতলা ভবন ‘রানা টাওয়ার’। ভবনটিতে নির্মাণ কাজ চলা অবস্থাতে পিলারে ফাটল দেখা দিলে দুর্ঘটনার আগের দিন ভবনটি বন্ধ করে প্রশাসন। রানা টাওয়ারের পাশে রয়েছে তাদের ছয়তলা বাসভবন। এ ছাড়া ধামরাইয়ের কালামপুরে রানার পরিবারের একটি ইটভাটা রয়েছে বলে জানা গেছে।
এদিকে পালানোর আগে তিনি তার বিশ্বস্ত সহযোগী নিয়ে বিভিন্ন ব্যাংকে তার অ্যাকাউন্ট থেকে প্রায় ২৩ কোটি টাকা উত্তোলন করেছেন বলেও জানা গেছে। প্রসঙ্গত, বিল্ডিংকোড অনুসরণ না করায় ভবন মালিক রানার বিরুদ্ধে ইতোমধ্যেই মামলা করেছে রাজউক। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ছাত্রলীগে যোগ দেন রানা। ১৯৯৮ সালে সাভার পৌর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মনোনীত হন তিনি। চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত এ পদেই ছিলেন। গত জানুয়ারিতে পৌর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক হন তিনি। সাভার যুবলীগের প্রভাবশালী নেতা রানা স্থানীয় সাংসদ তৌহিদ জং মুরাদের খুবই ঘনিষ্ঠ। উল্লেখ্য, বুধবার সকাল ৯টার দিকে ৮তলা ওই ভবন ধসে যায়। ভবনটির ৩য় থেকে ৮ম তলায় ৫টি গার্মেন্টস কারখানায় ৩ হাজারের বেশি শ্রমিক কর্মরত ছিলেন।
বেঁচে যাওয়া শ্রমিকরা অভিযোগ করেছেন, আগের দিন ভবনে ফাটল হয় ও পিলার ধসে পড়ে। তা সত্বেও বুধবার সকালে তাদের জোর করে কারখানায় ঢোকানো ও কাজ করতে বাধ্য করা হয়। এ ধসের ঘটনায় রোববার দুপুর সোয়া ৩টা পর্যন্ত ৩৭৩ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩৪৮ জনের লাশ স্বজনের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। অন্য লাশগুলো হস্তান্তরের অপেক্ষায় রয়েছে। জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে দুই হাজার ৪৭৯ জনকে।
অন্যদিকে রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় দায়ের হওয়া ২ মামলায় এ পর্যন্ত রানা ছাড়াও তার স্ত্রীসহ ৪ জন আত্মীয়, ৩ জন গার্মেন্টস মালিক ও ৪ জন প্রকৌশলীসহ মোট ১২ জনকে গ্রেফতার করেছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।