নিউজডেস্ক :ত্যাগে আর বিপ্লবে শত বছর পার করা বিনোদ বিহারী চৌধুরীর কর্মময় জীবনকে স্মরণ করলেন শেষ শ্রদ্ধা জানাতে আসা সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। শুক্রবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরীর প্রতি রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শেষ শ্রদ্ধা জানানো হয়। এ সময় গণঐক্যের আহ্বায়ক বর্ষীয়ান বাম নেতা পঙ্কজ ভট্টাচার্য বিনোদ বিহারীর কর্মময় দীর্ঘ জীবনকে আখ্যায়িত করলেন 'তারুণ্য আর যৌবনের প্রেরণার উৎস' হিসাবে। "গোটা জীবদ্দশায় সংগ্রাম আর ত্যাগের যে উদাহরণ তিনি রেখে গেছেন তার তুলনা বিরল। তার শতবছরের জীবনের প্রায় ৮০ বছর তিনি সক্রিয় ছিলেন শুধুই মানুষের মাঝে।" 'মানবধর্মের পূজারী' বিনোদ বিহারী সম্পর্কে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম ট্রাস্টি মফিদুল হক বলেন, "জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত উনি মানবকল্যাণে কাজ করে গেছেন।
তাই নিজেদের একজন মানুষ হিসাবে সবাই তাকে খুব অনায়াসে গ্রহণ করেছে।” "চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের একটা অংশ তিনি। এর পরেও সারাজীবন তিনি ধারাবাহিকভাবে কাজ করেছেন। নিজের জন্য তিনি কখনো কিছু প্রত্যাশা করেননি। প্রাপ্তির জন্য কোনো কাজ করেন নি। তিনি শুধু দিয়েই গেছেন।" বিনোদ বিহারীর ত্যাগের উদাহরণ দেন মফিদুল হক, "তাকে যখন স্বাধীনতা পদকের সঙ্গে পাওয়া দুই লক্ষ টাকা তিনি দান করে গেছেন। এই টাকা এবং ওনার জীবনের সঞ্চয়গুলো উনি একত্র করে উনি এশিয়াটিক সোসাইটিকে দিয়ে গেছেন মাস্টার দা সূর্যসেনের জন্য একটা স্মারক বক্তৃতা প্রবর্তনের জন্য।" ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে মাস্টারদা সূর্য সেনের সঙ্গী ছিলেন বিনোদ বিহারী। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির বিনোদ বিহারীকে স্মরণ করলেন মৌলবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী আন্দোলনের 'পুরোগামি' নেতা হিসাবে। "একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের যে আন্দোলন জাহানারা ইমাম শুরু করেছিলেন সেই আন্দোলনের সূচনা পর্ব থেকেই বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। চট্টগামের নির্মূল কমিটির তিনি উপদেষ্টা পরিষদের সভাপতি ছিলেন। দুই মাস আগেও তার সঙ্গে আমরা চট্টগ্রামে সমাবেশ করেছি।" বিনোদ বিহারী সম্পর্কে বলতে গিয়ে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের কন্ঠে অবশ্য একটু ক্ষোভই ঝরল, "আমাদের মুক্তিসংগ্রামের যে ঐতিহাসিকতা তাতে করে ৪৭ এর আগের ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় মাস্টারদা সূর্যসেন, ক্ষুদিরাম কিংবা বিনোদবিহারীর মতো ব্যক্তিদের মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া উচিত ছিল। এটা আমাদের ঐতিহাসিক কার্পণ্য।” বিপ্লবীর মরদেহ শহীদ মিনারে পৌঁছালে ঢাকার জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে গার্ড অব অনার দেয়া হয়। এ সময় বিউগলে বাজানো হয় বিদায়ের করুণ সুর। পরে বিনোদ বিহারীর মরদেহ শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য রাখা হয় অস্থায়ী মঞ্চে। সেখানে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে ফুল দেয়ার পর বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের পক্ষ থেকে একে একে শ্রদ্ধা জানানো হয়। বিপ্লবীকে শেষ বারের মতো শ্রদ্ধা জানাতে আসা অন্যদের মধ্যে ছিলেন টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী সাহারা খাতুন ও বস্ত্রমন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব উল আলম হানিফ, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, গণফোরাম প্রেসিডেন্ট ড. কামাল হোসেন, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের চেয়ারম্যান এ কে আজাদ চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফীন সিদ্দিক, জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. আনোয়ার হোসেনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতা কর্মীরা। বিরোধী দলের পক্ষ থেকে সাদেক হোসেন খোকাসহ কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানান। এছাড়া গণজাগরণ মঞ্চ থেকে ইমরান এইচ সরকারের নেতৃত্বে তাকে শ্রদ্ধা জানানো হয়। এর আগে শুক্রবার দুপুরে বিপ্লবীর মরদেহ শহীদ মিনারে পৌঁছালে ঢাকার জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে গার্ড অব অনার দেয়া হয়।এ সময় বিউগলে বাজানো হয় বিদায়ের করুণ সুর। ঢাকার সহকারী কমিশনার মো. রাসেলুল কাদের এ সময় উপস্থিত ছিলেন। পরে বিনোদ বিহারীর মরদেহ শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য রাখা হয় অস্থায়ী মঞ্চে। প্রথমে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের পক্ষে মরদেহে পুস্পস্তবক অর্পণ করেন তার সহকারী একান্ত সচিব একেএম মনিরুল ইসলাম। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান তার বিশেষ সহকারী মাহবুবুল হক শাকিল ও ব্যক্তিগত সহকারী সাইফুজ্জামান শিখর। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় এই বিপ্লবীর প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর পর হেলিকপ্টারে করে তার কফিন নিয়ে যাওয়া হয় চট্টগ্রামে। বিনোদ বিহারীর ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত জানান, সন্ধ্যা ৬টার দিকে চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে পৌঁছায় কফিনবাহী হেলিকপ্টারটি। সেখান থেকে মরদেহ নেয়া হয় জেএমসেন হলে, সেখানে মাস্টারদার সূর্যসেনের আবক্ষ ভাস্কর্যের পাদদেশে বিনোদ বিহারীর কফিন রাখা হবে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য। এরপর চট্টগ্রাম শহীদ মিনারে এই বিপ্লবীর প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাবে চট্টগ্রামের সর্বস্তরের মানুষ। সবশেষে বলুয়ার দীঘি অভয়মিত্র শ্মশানে শেষকৃত্য হবে বলে রানা দাশ গুপ্ত জানান। বাংলাদেশ সময় বুধবার রাত সোয়া ১০টার দিকে দক্ষিণ কলকাতার ফর্টিস হাসপাতালে মারা যান বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে মাস্টারদা সূর্য সেনের এই সঙ্গীর বয়স হয়েছিল ১০৩ বছর। শুক্রবার বেলা ১২টা ৫ মিনিটে বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইটে ঢাকা পৌঁছায় বিনোদ বিহারীর মরদেহ। তার পুত্রবধূ উপালি চৌধুরী ও পৌত্র সোমশুভ্র চৌধুরীও একই ফ্লাইটে দেশে আসেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে বিমানবন্দরে বিনোদ বিহারীর মরদেহ গ্রহণ করেন প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী সাইফুজ্জামান শিখর। প্রয়াতের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত ও আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক পঙ্কজ দেবনাথ এ সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন। বিমান থেকে নামানোর পর বিনোদ বিহারীর কফিন জাতীয় পতাকায় জড়িয়ে ফুলে সাজানো একটি গাড়িতে তোলা হয়। ১৯১১ সালের ১০ জানুয়ারি চট্টগ্রামের বোয়ালখালীতে জন্ম নেয়া বিনোদ বিহারী ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেন।