ঢাকা: পুরনো বছরকে বিদায় জানিয়ে ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে বরণ করে নিয়েছে ১৪২০ বঙ্গাব্দকে। সার্বজনীন এ উৎসবে নগরীর পথে পথে এখন লাখো মানুষের ঢল। অশুভ শক্তিকে বিতাড়ন করা মঙ্গল শোভাযাত্রায় দেখা গেছে সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আর সম্প্রীতির জোয়ার। সার্বজনীন এ উৎসবের নানা আয়োজনের মধ্যে অন্যতম আকর্ষণ মঙ্গল শোভাযাত্রা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের এ বর্ণিল আয়োজনটি রঙে-ঢঙে পায় ভিন্ন এক মাত্রা।
তরুণ শিল্পীদের রাত-দিন মননশীল শ্রমে গড়ে উঠেছে শোভাযাত্রার নানা অনুষঙ্গ। আর এসব নবীণ শিল্পীদের নানা পরামর্শ দিয়ে কাজকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন চারুকলার শিক্ষক ও সাবেক শিক্ষার্থীরা। এবারের পঁচিশতম শোভাযাত্রার স্লোগান ‘রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশ/মুক্তিযুদ্ধ অনিশ্বেষ’। রোববার পহেলা বৈশাখ সকাল পৌনে ১০টায় চারুকলা ইনস্টিটিউটের সামনে থেকে বের হয় বর্ষবরণের মঙ্গল শোভাযাত্রা। ঢাক-ঢোল, খঞ্জনিসহ নানা বাদ্য-বাজনার মুখরতার সঙ্গে আয়োজনের মূল অনুষঙ্গ ছিল নয়টি শিল্প-কাঠামো, হরেক রকমের মুখোশ, টাট্টু ঘোড়া ও বর্ণিল প্ল্যাকার্ড।২৪ জন ঢাকি ঢাক বাজিয়ে শোভাযাত্রার সূচনা করেন। এর পরপরই ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতির মেলবন্ধনে গড়ে তোলা নানা অনুষঙ্গ নিয়ে শুরু হয় শোভাযাত্রা। জাতীয় মঙ্গল শোভাযাত্রা উদযাপন পর্ষদের আহ্বায়ক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকী সকাল সাড়ে ৯টায় মঙ্গল শোভাযাত্রার আনুষ্ঠানিক উদ্বোন করেন। এরপর শোভাযাত্রাটি চারুকলা থেকে বেরিয়ে শাহবাগ মোড় পেরিয়ে রূপসী বাংলা ঘুরে টিএসসি হয়ে পুনরায় চারুকলায় এসে শেষ হয়। বরাবরের মতো এবারও মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজনের নির্দেশনায় ছিলেন স্নাতকোত্তর শেষ বর্ষের শিক্ষার্থীরা। নানা বিষয়ে তাদের পরামর্শ দিচ্ছেন অনুষদের ডিন আবুল বারক আলভী এবং দুই শিল্পী-শিক্ষক শিশির ভট্টাচার্য ও নিসার হোসেন। চারুকলার সিরামিক বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী নবেন্দু সাহা নব বাংলানউজকে বলেন, “এবারের শোভাযাত্রার মূল অনুষঙ্গ হিসেবে থাকছে নয়টি শিল্প-কাঠামো। সর্বজনীন এ শোভাযাত্রার নানা শিল্প-কাঠামোয় লোকজ সংস্কৃতির পাশাপাশি তুলে আনা হয়েছে চলমান সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট।”
তিনি আরও বলেন, “এবারের শোভাযাত্রায় যুক্ত হয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে নির্মিত শিল্পকর্ম। যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে গড়ে ওঠা গণজাগরণের প্রতীক উপস্থাপন করা হয়েছে চৌদ্দ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট মুষ্ঠিবদ্ধ হাতের মাধ্যমে। তাছাড়া যুদ্ধাপরাধীদের সাম্প্রতিক অপতৎরতাও তুলে ধরা হয়েছে শোভাযাত্রার অনুষঙ্গে। শোভাযাত্রায় গণজাগরণ মঞ্চের ১০০জন কর্মী এই মুষ্ঠিবদ্ধ হাতের সঙ্গে ছিলেন আড়াই হাত বাঁশের লাঠি নিয়ে। শোভাযাত্রায় স্থাপন করা হয়েছে ‘রাজাকারের কবলে বাঘ’ শিরোনামের একটি শিল্প-কাঠামো। বিশালাকৃতির ভয়ঙ্কর ও কুৎসিত মুখাবয়বের রাজাকার দুই হাতে গ্রাস করতে চাইছে বাংলাদেশের প্রতীক রয়েল বেঙ্গল টাইগারকে। এই শিল্প-কাঠামোর দৈর্ঘ্য ১৬ ফুট। অশুভের প্রতীক হিসেবে স্থাপন করা হয়েছে ৬০-৬৫ ফুট দৈর্ঘ্যের বিশাল সরীসৃপ। দুই পা-ওয়ালা ভয়ঙ্কর এ সরীসৃপের হা করা আগ্রাসী মুখ।
তারুণ্যের প্রতীক হিসেবে শোভাযাত্রায় ছিল শান্তির পায়রা। সকল ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা ঘুচিয়ে সমন্বিত সমাজ গঠনের প্রকাশ ছিল এই শিল্প-কাঠামোয়। সদ্য প্রয়াত চারুকলার শিল্পী ও শিক্ষক মরণ চাঁদ পালের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে শোভাযাত্রায় স্থাপন করা হয় তার রিকশা মোটিভের শিল্প-কাঠামো। হাতির পিঠে যুদ্ধাংদেহী শীর্ষক শিল্প-কাঠামোয় ছিল যুদ্ধাপরাধের বিচার দাবিতে তরুণ প্রজন্মের এক যোদ্ধার লড়াইয়ের দীপ্ত প্রত্যয়। এ ছাড়াও শোভাযাত্রায় ছিল বাঁকুড়ার পোড়ামাটির ঘোড়া, ১২টি টাট্টু ঘোড়া, রাজা-রানি, উজির-নাজির, বাঘ, পেঁচা ও টেপা পুতুলসহ নানা আকৃতি ও বর্ণের অসংখ্য মুখোশ এবং রং-বেরঙের প্ল্যাকার্ড।