নিউজডেস্ক : ৪২ বছরের ইতিহাসে প্রথম নারী স্পিকার পেতে যাচ্ছে দেশ। এই পদে মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী শিরিন শারমিন চৌধুরীকে মনোনীত করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। মঙ্গলবারই সংসদ সদস্যরা আনুষ্ঠানিকভাবে আবদুল হামিদের উত্তরসূরি নির্বাচন করবেন। তবে সংসদে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় ৪৬ বছর বয়সি শিরিন শারমিনের স্পিকার হওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। সংরক্ষিত মহিলা আসনের সদস্য হিসেবে এবারই প্রথম সংসদে এলেন পেশায় আইনজীবী শিরিন শারমিন, ছাত্রজীবনে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখা এই নারী যুক্তরাজ্যের এসেক্স ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি ডিগ্রি নেন।
সংসদে নির্বাচনের আগের দিন সন্ধ্যায় সংসদ ভবনে শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের সভায় স্পিকার হিসেবে শিরিন শারমিনের নাম চূড়ান্ত হয় বলে সাংবাদিকদের জানান দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী।বৈঠকে দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম দলের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক শিরিন শারমিনের নাম প্রস্তাব করলে তা সমর্থন করেন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী। পরে এই প্রস্তাবই সভায় অনুমোদিত হয়। জিল্লুর রহমানের মৃত্যুর পর নবম সংসদের স্পিকার আবদুল হামিদ রাষ্ট্রপতি হওয়ায় মেয়াদের এক বছরের কম সময় বাকি থাকতে এই পদে নির্বাচন হতে যাচ্ছে। সংরক্ষিত আসন থেকে স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, চিফ হুইপ বা হুইপ নির্বাচিত হওয়ার প্রথম নজির শিরিন শারমিনই স্থাপন করতে যাচ্ছেন। স্পিকার নির্বাচিত হলে তাকে প্রতিমন্ত্রীর পদ ছাড়তে হবে।
আবদুল হামিদ রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন শুরু করার পর ডেপুটি স্পিকার শওকত আলী ভারপ্রাপ্ত স্পিকারের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। মঙ্গলবার নতুন স্পিকার নির্বাচনের পর তার সেই দায়িত্বের অবসান ঘটবে। ডেপুটি স্পিকার পদে নতুন কেউ আসছেন বলে সংবাদ মাধ্যমে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এই বিষয়ে জানতে চাইলে মতিয়া চৌধুরী বলেন, “খালি হয়েছিলো তো স্পিকারের পদ।” সংসদ সচিবালয়ের সচিব মো. মাহফুজুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, স্পিকার নির্বাচন এবং শপথ অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ নতুন স্পিকারের শপথ পড়াবেন।
সংবিধান অনুযায়ী, স্পিকার কিংবা ডেপুটি স্পিকারের পদ শূন্য হলে সাত দিনের মধ্যে তা পূরণ করতে হবে। গত ২৪ এপ্রিল দেশের ২০তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন আবদুল হামিদ। তার সংসদীয় আসন শূন্য ঘোষণা করে ২৫ এপ্রিল বিজ্ঞপ্তি জারি করে সংসদ সচিবালয়। মঙ্গলবার সংসদ অধিবেশনে আওয়ামী লীগ স্পিকার হিসেবে শিরিন শারমিনের নাম প্রস্তাব করলে যদি আর কোনো প্রস্তাব না আসে তবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হবেন তিনি। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনেও সংসদে আওয়ামী লীগ প্রস্তাবিত আবদুল হামিদ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। বিরোধী দল অনেক দিন ধরেই সংসদ বর্জন করে আসছে।
শিরিন শারমিন স্পিকার হলে সংসদে কর্তৃত্বময় তিনটি পদই থাকবে নারীদের হাতে। সংসদ নেতার দায়িত্বে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেতা হচ্ছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এদের সঙ্গে সংসদ উপনেতাও একজন নারী, তিনি হলেন সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। শেখ হাসিনার সরকারে গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে রয়েছেন নারীরা। তাদের মধ্যে রয়েছেন- কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি, ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী সাহারা খাতুন। সম্প্রতি সর্বোচ্চ আদালত অর্থাৎ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে প্রথম নারী হিসেবে নিয়োগ পানিএকজন নারী, নাজমুন আরা সুলতানা।
শিরিন শারমিন স্পিকার হলে ভারতবর্ষের তিনটি দেশ বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান তিনটি দেশেই পার্লামেন্টের স্পিকারের দায়িত্বে থাকবেন নারীরা। ভারতে মীরা কুমার এবং পাকিস্তানে ফাহমিদা মির্জা স্পিকারের দায়িত্ব পালন করছেন। শিক্ষা জীবনে অসাধারণ কৃতিত্ব দেখানো শিরিন শারমিনের জন্ম ১৯৬৬ সালে ৬ অক্টোবর ঢাকায়। তার বাবা রফিকউল্লাহ চৌধুরী ছিলেন স্বাধীনতার পর প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একান্ত সচিব। তার মা অধ্যাপক নাইয়ার সুলতানা বাংলাদেশ কর্ম কমিশনের সদস্য ছিলেন। তার নানা সিকান্দার আলী ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান হাই কোর্টের বিচারপতি।
১৯৮৩ সালে ঢাকা বোর্ড থেকে মানবিক বিভাগে সম্মিলিত মেধাতালিকায় প্রথম স্থান নিয়ে এসএসসি পাস করেন শিরিন। দুই বছর পর একই বোর্ড থেকে মানবিক বিভাগে সম্মিলিত মেধাতালিকায় দ্বিতীয় স্থান নিয়ে এইচএসসি উত্তীর্ণ হন তিনি। ১৯৮৯ সালে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এল এল বি (অনার্স) এবং ১৯৯০ সালে ওই স্থান অটুট রেখেই এলএলএম ডিগ্রি নেন শিরিন শারমিন। এরপর উচ্চ শিক্ষার জন্য কমনওয়েলথ স্কলারশিপ নিয়ে যুক্তরাজ্যে যান তিনি। ২০০০ সালে এসেক্স ইউনিভার্সিটি ‘রাইট টু লাইফ’ অভিসন্দর্ভের জন্য তিনি পিএইচডি লাভ করেন। ১৯৯২ সালে বার কাউন্সিল আইনজীবী হিসাবে তালিকাভুক্ত হন শিরিন। ১৯৯৪ সালে হাই কোর্ট বিভাগ ও ২০০৮ সালে আপিল বিভাগে অন্তর্ভুক্ত হন তিনি। সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো পরিচালনার দায়িত্বে থাকা আইনজীবীদের একজন তিনি। শিরিন শারমিন ২০০৩ সালে বাংলাদেশ বার কাউন্সিল লিগাল ডিভিশনের এডিটর ছিলেন। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ল’ অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল এফেয়ার্সের (বিলিয়া) নির্বাহী কমিটি এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য তিনি।
আইনজীবী হিসাবে পেশাগত জীবনে নারীর সম-অধিকারের জন্য কাজ করে আসছেন শিরিন শারমিন। তিনি প্রতিমন্ত্রী থাকা অবস্থায়ই ‘নারী উন্নয়ন নীতিমালা’ সংসদে পাস হয়। শিরিন শারমিনের স্বামী ওষুধ শিল্পের পরামর্শক সৈয়দ ইশতিয়াক হোসেন। তাদের এক ছেলে এবং এক মেয়ে রয়েছে।