নিউজডেস্ক : সাভারে ভবন ধসের সপ্তাহ গড়ালেও নিখোঁজের সঠিক কোনো পরিসংখ্যান এখনো পাওয়া যায়নি, ফলে জানা যাচ্ছে না ভেতরে কত মানুষের লাশ রয়েছে। ছবি নিয়ে এখনো ধ্বংসস্তূপের সামনে জড়ো হয়ে আছেন হাজারো মানুষ, স্বজনের লাশের জন্য অপেক্ষা তাদের। গত ২৪ এপ্রিল কারখানায় থাকা শ্রমিকদের তালিকা পেলে জীবিত ও মৃত অবস্থায় উদ্ধারদের হিসাব করে নিখোঁজদের তালিকা করা যেত। কিন্তু পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র কাছে তালিকা চাইলেও তা পাওয়া যায়নি বলে উদ্ধার অভিযানে নেতৃত্ব দেয়া সেনাবাহিনী জানিয়েছে।
ধসে পড়া নয়তলা ভবনটিতে পাঁচটি কারখানা ছিল এবং ধসের সময় সেগুলোতে কাজও চলছিল। ভবন ধসের পর ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কর্মকর্তারা বলেছিলেন, সাড়ে ৩ হাজারের মতো শ্রমিক কাজ করছিলেন। তবে উদ্ধার হওয়া শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে ধারণা মিলল, ধসের সময় সাড়ে ৪ হাজারের বেশি শ্রমিক সেখানে কাজ করছিলেন।মঙ্গলবার দুপুরে ধ্বংসস্তূপের সামনে এক সংবাদ সম্মেলনে উদ্ধার কাজের সমন্বয়ক মেজর জেনারেল চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দী বলেন, কারখানাগুলোতে ৩ হাজার ২০০ লোক কাজ করতেন বলে তারা শুনেছেন। ধসের দিন হরতাল থাকায় অনেক শ্রমিক কাজে যোগ দেয়নি বলে ধারণা সেনাবাহিনীর নবম পদাতিক ডিভিশনের অধিনায়কের। নিখোঁজের সংখ্যা জানতে চাইলে এই দুটি ধারণা তুলে ধরে মেজর জেনারেল সোহরাওয়ার্দী বলেন, “নিখোঁজ কত হতে পারে আপনারাই বুঝে নিন।” তিনি জানান, মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত ২ হাজার ৮১৮ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে ২৪৩৭ জনকে জীবিত এবং ৩৮৫ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। জীবিত ও মৃত উদ্ধারের অনুপাত ৮:১। আহতদের মধ্যে যারা হাসপাতালে মারা গেছেন, তাদের হিসাব নিহতের এই তালিকায় যোগ হয়নি। উদ্ধার কাজের সমন্বয়ক যে হিসাব দিয়েছেন, তাতে নিখোঁজের সংখ্যা হতে পারে চারশ’র মতো। কিন্তু নিখোঁজের যে তালিকা পুলিশ করেছে, তাতে এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৩শ’র মতো। এই তালিকা লাশ রাখার স্থান অধরচন্দ্র বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ঝোলানো রয়েছে। ওই তালিকার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে মেজর জেনারেল সারওয়ার্দী বলেন, “ওই তালিকার সঙ্গে আমরা একমত হতে পারছি না।”
গত তিন বছর ধরে রানা প্লাজার সাত তলার কারখানায় কর্মরত শরিফুল ইসলাম সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ওই ফ্লোরেই কাজ করছিল আট থেকে নয়শ’ শ্রমিক। তৃতীয় তলায় কাজ করা সবুজ মিয়া বলেন, প্রায় ৮০০ শ্রমিক ওই তলায় ছিল। চতুর্থ তলা থেকে তিন দিন পর জীবিত উদ্ধার কারখানা কর্মকর্তা নাজমুর রশীদ ফারুক বলেন, ধসের সময় ওই তলায় এক হাজারের মতো শ্রমিক ছিলেন। ষষ্ঠ তলা থেকে আহত অবস্থায় উদ্ধার মেহেদী হাসান বলেন, সেই তলায় কাজ করতেন এক হাজার শ্রমিক এবং বেশিরভাগই ওইদিন কাজে এসেছিলেন। নবম তলায় মেশিনপত্র বসানোর কাজ চলছিল। ওই ফ্লোরেও অর্ধশতাধিক লোকজনকে কাজ করতে দেখেছেন মেহেদী। পঞ্চম তলায়ও কমপক্ষে সাতশ’ শ্রমিক ছিল বলে অন্যরা বলছেন। অষ্টম তলায় আটশ’ শ্রমিক কাজ করতেন জানিয়ে কারখানার শ্রমিক মোন্নাফ খান বলেন, হরতাল হলেও মাস শেষে বেতনের কথা চিন্তা করে সব শ্রমিকই কারখানায় এসেছিল। “মাসের শেষ দিকে উপস্থিত না থাকলে কারখানার ম্যানেজার বেতন দিতে ঝামেলা করেন,” বলেন তিনি।
স্বজনদের সন্ধানে যারা রয়েছেন, অধরচন্দ্র বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে তারা পুলিশের কাছে নাম জমা দিচ্ছেন। সেখানে সোমবার দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তা এসআই ফিরোজ আলম সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, একজনের নাম একাধিকবার তালিকাভুক্ত হওয়া এবং নিখোঁজ কারো সন্ধান পরে মিললেও তালিকা থেকে নাম বাদ না পড়ায় এই সংখ্যা কমতে পারে। ধসের পর উদ্ধার অভিযানে সাধারণ মানুষদের যারা ছিলেন, তারা বলছেন- ভেতরে অনেক লাশ দেখে এসেছেন তারা। ভাগ্নে আরিফুর রহমানের সন্ধানে থাকা সাভারের সবুজবাগের ইউনুস খান সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, “আমি নিজে ভবনে ঢুকে এর উত্তর-পূর্ব কোণার দিকে অনেক লাশ দেখে এসেছি। অথচ ভারী যন্ত্রপাতি সেদিকে ব্যবহার না করে সামনে ও পেছনে ব্যবহার করা হচ্ছে, যেখানে লাশ নেই।” ধসের পর জীবিতদের উদ্ধারকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে ভারী যন্ত্রপাতি ব্যবহার হয়নি। পঞ্চম দিন রোববার রাতে উদ্ধার অভিযানে যোগ হয় ভারী সরঞ্জাম। এরপর মঙ্গলবার বিকাল পর্যন্ত উদ্ধার হয়েছে নয়টি লাশ। ভারী সরঞ্জাম নিয়েও সতর্কতার সঙ্গে কাজ চলছে বলে জানান উদ্ধার অভিযানের সমন্বয়ক সারওয়ার্দী। “আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করছি যদি কেউ জীবিত থাকে তাকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করতে।১৪৮ ঘণ্টার বেশি পার হয়ে গেছে, তবুও কেউ যদি বেঁচে থাকেন আল্লার ইচ্ছায়।” উদ্ধার হওয়া লাশগুলো রাখা হচ্ছে অধর চন্দ্র মাঠে, সেখানে যাদের পরিচয় সনাক্ত করা যায়নি, সেগুলো নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল মর্গে। উদ্ধার লাশের মধ্যে সনাক্তের পর ৩৩৩টি হস্তান্তর হয়েছে জানিয়ে জেনারেল সারওয়ার্দী বলেন, ৫২টির পরিচয় না পাওয়ায় সেগুলো মর্গে রয়েছে।অধর চন্দ্র মাঠে ও রানা প্লাজার সামনে যারা সপ্তম দিনেও নিখোঁজদের জন্য অপেক্ষা করছেন, তাদের প্রায় সবাই বলেছেন, লাশের পাশাপাশি আহতদের দেখতে বিভিন্ন হাসপাতালেও ছুটেছেন তারা। কিন্তু স্বজনদের না পাওয়ায় অপেক্ষারতদের ধারণা, তারা যাদের খুঁজছেন, তারা এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচেই রয়েছেন।
সংবাদ সম্মেলনে এই বিষয়টি তুলে মেজর জেনারেল সারওয়ার্দী বলেন, “অনেকে সন্দেহ করছেন, আমরা ওই ট্রাকে করে লাশও সঙ্গে নিচ্ছি কি না? কেউ কেউ ওই গাড়িকেও বাধাগ্রস্ত করছেন। “নিজের প্রাণের মায়া ত্যাগ করে যারা এত মানুষকে উদ্ধার করল, তাদের দ্বারা কি এই কাজ সম্ভব?” খানিকটা ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন তিনি। নিখোঁজের বিষয়ে জেনারেল সারওয়ার্দী বলেন, কত লোক ওই ভবনে কাজ করতেন তার তালিকা পেলে নিখোঁজের সংখ্যা জানা যেত। “কিন্তু আমরা কোনো তালিকাই পাইনি।বিজিএমইএ সভাপতির কাছে জরুরি ভিত্তিতে এই তালিকা চাওয়া হয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘লিস্ট দেয়ার চেষ্টা করছি’।” পোশাক কারখানাগুলোর কোনো কম্পিউটারও পাওয়া যায়নি বলে জানান উদ্ধার অভিযানের সমন্বয়ক, যা পেলে শ্রমিকদের পরিসংখ্যান পাওয়া যেত। পোশাক কারখানাগুলো সব মালিকরাই গ্রেপ্তার রয়েছেন। তাদের কাছে তথ্য চেয়েছেন কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “তারা তো আমাদের কাস্টডিতে নেই।” দেশের ইতিহাসে ভয়াবহতম এই ভবন ধসে হতাহত ও নিখোঁজের সঠিক তথ্য না পাওয়া পর্যন্ত সংখ্যা প্রচার না করার জন্য সংবাদকর্মীদের অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি। আহত ও নিহতদের জেলাভিত্তিক একটি তালিকা শিগগিরই প্রকাশ করা হবে বলে জানান উদ্ধার অভিযানের সমন্বয়ক। গত রোববার বিদেশিরা উদ্ধার কার্যক্রম দেখে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন বলে জানান তিনি। উদ্ধার কাজে বিদেশি সহায়তা কেন ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে- জানতে চাওয়া হলে সমন্বয়ক বলেন, “যখন তারা এই প্রস্তাব দিয়েছিল, তখন থেকে উদ্ধার সরঞ্জাম আসতেও তো ৭২ ঘণ্টা সময় লেগে যেত।”