ঢাকা : প্রবীণ রাজনীতিক ও বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানকে পূর্নাঙ্গ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বনানী কবরস্থানে দাফন করা হলো শুক্রবার। দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহকর্মী ও জীবনসঙ্গিনী আইভী রহমানের কবরেই দাফন করা হয় তাকে। দীর্ঘ আট বছর এ কবরেই শায়িত ছিলেন আইভি রহমান।
শুক্রবার বেলা পৌনে চারটায় বনানী কবরস্থানে এসে পৌঁছায় রাষ্ট্রপতির মরদেহ। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি অ্যাডভোকেট আব্দুল হামিদ মরদেহ গ্রহণ করেন। মরদেহ আসার সঙ্গে সঙ্গে প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্ট প্রয়াত রাষ্ট্রপতিকে গার্ড অব অনার প্রদান করে। রাষ্ট্রপতির মরদেহ বহনকারী সামরিক গাড়ি থেকে প্রথমে কফিনটি নামানো হয় একটি ১০৫ এমএমএর কামানে স্থাপিত শকটে। সেটায় করে কবরস্থানের গেটে যাওয়ার পর তিন বাহিনীর ১০ জেনারেল বা সমমর্যাদার কর্মকর্তা কফিন ঘাড়ে তুলে নেন। সেনা চৌকস দলের প্যারেডের তালে তালে রাষ্ট্রপতির কফিন প্রবেশ করে বনানী কবরস্থানে। রাষ্ট্রপতির এ শবযাত্রায় কফিনের পেছনেই ছিলেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও স্পিকার অ্যাডভোকেট আব্দুল হামিদ। তার পেছনে ছিলেন মন্ত্রিপরিষদ সদস্য এবং সামরিক কর্মকর্তারা। তাদে পেছনেই ছিলেন রাষ্ট্রপতির আত্মীয়-স্বজন ও আওয়ামী লীগ নেতারা। রাষ্ট্রপতির মরদেহ কবরে পৌঁছানোর পর প্রথমে দুই মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। পরে রাষ্ট্রপতির জীবন ও কর্ম পাঠ করেন আর্টিলারি ব্রিগেডের একজন মেজর। বিকেল সাড়ে ৪টার কিছু আগে রাষ্ট্রপতির তিন নিকটাত্মীয় মরদেহ কবরে নামান। কবরে নামানোর পর ধর্মীয়ভাবে দাফন সম্পাদন করেন সেনাবাহিনীর কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের খতিব মাওলানা মাহমুদুল হক। ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা ও দাফন শেষে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা গান স্যালুট প্রদান করেন। সেনাবাহিনীর গোলন্দাজ দলের ১০৫ মিলিমিটারের ৮টি প্যাক হাইজ কামান এ সময় ২১ বার গর্জে ওঠে। এরপর দেওয়া হয় গার্ড ফায়ারের সম্মান। প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্টের একটি দল ভলি ফায়ার করে প্রয়াত রাষ্ট্রপতিকে শ্রদ্ধা জানান। এ সময় তাদের স্বয়ংক্রিয় রাইফেল থেকে তিনবার শূন্যে ফায়ার করা হয়। দাফন শেষে রাষ্ট্রপতির কবরে প্রথমে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও স্পিকার আব্দুল হামিদ। এরপর একে একে পর্যায়ক্রমে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে তার সামরিক সচিব, আওয়ামী লীগের পক্ষে দলের সাধারণ সম্পাদক স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এমপি, প্রধান বিচারপতি, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন এবি তাজুল ইসলাম, সেনাবাহিনী প্রধান, নৌ-বাহিনী প্রধান, ভারপ্রাপ্ত বিমান বাহিনী প্রধান, কূটনৈতিক কোরের ডিন, এসএসএফ, স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী, পররাষ্ট্র মন্ত্রী, ডেপুটি স্পিকার, মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত, জাপানি রাষ্ট্রদূত, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
এরপর সশস্ত্র বাহিনীর গার্ড রাষ্ট্রপতিকে মরণোত্তর সালাম প্রদান করেন। পরে প্রয়াত এ রাষ্ট্রপতির রুহের মাগফিরাত কামনা করে দোয়া পরিচালনা করা হয়। এর পর রাষ্ট্রপতির ছেলে নাজমুল হাসান পাপনের কাছে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ জাতীয় পতাকা হস্তান্তর করেন। সবশেষে বিউগলে জাতীয় সঙ্গীত ও করুণ সুরের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়।
এদিকে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের শেষ আনুষ্ঠানিকতার জন্য দুই দিন ধরে প্রস্তুত করা হয় বনানী কবরস্থান। চালানো হয় কয়েকবার মহড়া। কবরস্থানের সামনে সেনাবাহিনীর গোলন্দাজ দল, প্যারেড দল, অবস্থান নেয়। রাষ্ট্রপতির দাফনের তত্ত্বাবধান করে সেনাবাহিনীর ৪৬ ব্রিগেডের একটি ইউনিট। এছাড়াও সিগন্যাল কোরের ৭৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কর্মকর্তারা দাফন অনুষ্ঠান পরিচালনা করবেন। স্যালুট পরিচালনা করে প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্ট। রাষ্ট্রপতির জীবন ও কর্ম পাঠ ও প্যারেড পরিচালনার জন্য কয়েকটি বড় বড় সাউণ্ডবক্স স্থাপন করে সেনা সদর দফতর। রাষ্ট্রপতির দাফন অনুষ্ঠান সুশৃঙ্খল করার জন্য ৪৬ ব্রিগেডের একটি ইউনিট শুক্রবার সকাল থেকেই সার্বিক ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত ছিল।
এর আগে বেলা ৩টার দিকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ অ্যাডভোকেট কবরস্থানে এসে পৌঁছান। চলে আসেন প্রধানমন্ত্রীর প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিকসহ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাসহ সামরিক কর্মকর্তারাও। এছাড়া সোয়া ৩টার দিকে প্রয়াত রাষ্ট্রপতির ছেলে নাজমুল হাসান পাপনের নেতৃত্বে পরিবারের সদস্যরা কবরস্থানে এসে পৌঁছান।
বুধবার স্থানীয় সময় বিকেল ৪টা ৪৭ মিনিটে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান। বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টায় বাংলাদেশ বিমানের একটি বিশেষ ফ্লাইটে তাকে ঢাকায় আনা হয়। ১২টা ১০ মিনিটে ফ্লাইট থেকে রাষ্ট্রপতির কফিন নামানো হয়। পরে রাষ্ট্রপতির মরদেহ বঙ্গভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে শ্রদ্ধা জানানোর পর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের হিমঘরে তার মরদেহ রাখা হয়। তার মৃত্যুতে বৃহস্পতিবার সাধারণ ছুটিসহ ৩ দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয়। প্রথম নামাজে জানাজার জন্য রাষ্ট্রপতির মরদেহ শুক্রবার সকালে বিশেষ হেলিকপ্টার যোগে তার জন্মস্থান ভৈরবে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে জানাজা শেষে হেলিকপ্টারটি আবার ঢাকার উদ্দেশে ভৈরব ত্যাগ করে। এ সময় ভৈরবের হাজার হাজার মানুষ হাত নেড়ে শেষ বিদায় জানায় তাদের প্রিয় নেতা জিল্লুর রহমানকে। ঢাকার জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে দুপুর ২টা ৩০ মিনিটে অনুষ্ঠিত হয় তার দ্বিতীয় নামাজে জানাজা। মাঝে সাড়ে ১২টার কিছু পর থেকে ১টা ৪৫ মিনিট পর্যন্ত বঙ্গভবনে রাখা হয় রাষ্ট্রপতির কফিন। সেখানে বিদেশি কূটনীতিকরা রাষ্ট্রপতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এর পর প্রয়াত রাষ্ট্রপতির মরদেহ শেষবারের মতো নেওয়া হয় গুলশানে তার নিজ বাসভবনে। সেখান থেকেই প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও জাতির অভিভাবক জিল্লুর রহমানের শেষ যাত্রা শুরু হয় বনানী কবরস্থানের দিকে।