শনিবার, ২৩ মার্চ, ২০১৩

‘আমরা চাই সরকার ও বিরোধী দল- উভয়ই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হোক’: আলোচনায় গনজাগরণ মঞ্চের ১০ জন সংগঠক

ঢাকা : শনিবার অনলাইন সংবাদপত্র বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের উদ্যোগে এক আলোচনা অনুষ্ঠানে যুদ্ধাপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি এবং জামায়াত নিষিদ্ধের আন্দোলনের সংগঠক এবং এ নিয়ে অনলাইনে লেখালেখিতে সক্রিয়রা বিরোধী দলকে নিয়ে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেন। “আমরা চাই সরকার ও বিরোধী দল- উভয়ই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হোক,” বলেন আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক মারুফ রসুল।
  গত ৫ ফেব্রুয়ারি এই আন্দোলন শুরুর পর এই প্রথম কোনো আলোচনায় একসঙ্গে ১০ জন সংগঠক একত্র হলেন। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদীর সঞ্চালনায় এই সভায় আন্দোলনের অর্জন, গতি, ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া এবং বিভিন্ন দাবির ব্যাখ্যা তুলে ধরেন তারা। আলোচনায় অংশগ্রহণকারীরা হলেন- মারুফ রসুল, মাহমুদুল হক মুন্সী, আরিফ জেবতিক, অমি রহমান পিয়াল, শারমিন রেজোওয়ানা, বাকী বিল্লাহ, আফসানা কিশোয়ার,  পিনাকী ভট্টাচার্য, নাহিদ সুলতানা ও সিমু নাসের। শুরুতে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়ে পরে অবস্থান বদলানো বিএনপির বিষয়ে অবস্থান জানতে চাইলে গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠকরা বলেন, জামায়াতকে বর্জন করে যদি বিএনপি নেত্রী এই আন্দোলনে শামিল হতে চান, তার জন্য দরজা খোলা রয়েছে। ব্লগার মাহমুদুল হক মুন্সী বলেন, “বিএনপির অবস্থান শুরুতে এক রকম ছিল, কিন্তু কয়েকদিন পর অন্য অবস্থান দেখা যায়। আমার মনে হয়, এত বড় একটা আন্দোলন নিয়ে তাদের অবস্থানটি তারা ঠিক করতে পারছিল না।” তিনি এইসঙ্গে বলেন, “বিএনপি নিজেদের বৃহৎ রাজনৈতিক দল বলে দাবি করে, তাদের দলে অনেকে মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন বলেও তারা দাবি করে, দলের প্রধান একজন মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী।” তবে বেসরকারি একটি ব্যাংকে কর্মরত আফসানা কিশোয়ার এক্ষেত্রে জামায়াতের জোটসঙ্গী বিএনপির কাছে কোনো প্রত্যাশা নেই বলে মত প্রকাশ করেন। এক্ষেত্রে জিয়াউর রহমানের আমলে গোলাম আযমের দেশে ফেরা, খালেদা জিয়ার আমলে তার নাগরিকত্ব পাওয়ার বিষয়টি তুলে ধরেন তিনি। তবে ক্ষমা চাওয়া নিয়ে তাৎক্ষণিক ভিন্নমত পোষণ করেন ডয়চে ভেলের সেরা ব্লগার পুরস্কারজয়ী আরিফ জেবতিক। তিনি বলেন, “তিনি দেশনেত্রী হয়েছেন তরুণদের আন্দোলনের মধ্য দিয়েই। তাই খালেদা জিয়াকে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে থাকতে হবে।” ইসলামী ছাত্র শিবিরের দ্বারা বিএনপি নেতা-কর্মীদের নির্যাতিত হওয়ার উদাহরণ হিসেবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি রুহুল কবির রিজভীর নাম তুলে ধরেন সাবেক ছাত্রদল কর্মী জেবতিক। ’৯০ এর আন্দোলনের অন্যতম ছাত্রনেতা ও রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক জিএস পিনাকী ভট্টাচার্যও বিএনপিকে আন্দোলনে দেখার প্রত্যাশা করেন। “নব্বইয়ে আমরা যখন আন্দোলন করছিলাম, তখন ছাত্রদলও সেই আন্দোলনে যোগ দিয়েছে। আমি এখনো বিশ্বাস করি যে তারা (বিএনপি) জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করে তরুণদের সঙ্গে যোগ দেবে।” শাহবাগ আন্দোলন শুরু হওয়ার পর বিএনপি কয়েকদিন পর্যবেক্ষণের পর একে স্বাগত জানায়, স্থায়ী কমিটির বিবৃতিও আসে। তবে কিছু দিন পরে বিএনপি অবস্থান পরিবর্তন করে। দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া শাহবাগ আন্দোলনকারীদের ‘নাস্তিক’ ও মঞ্চ-ফঞ্চ মন্তব্য করে গণজাগরণ মঞ্চ বন্ধের দাবি জানান। বিএনপির এ অবস্থান পরিবর্তন জানতে চাওয়া হলে ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি বাকী বিল্লাহ বলেন, “বিএনপি আসলে একটা পলিসিলেস পার্টি।”

গণজাগরণ মঞ্চ নিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে নেতিবাচক প্রচার চলছে জনিয়ে এজন্য মূল ধারার কয়েকটি সংবাদ মাধ্যমকেও দায়ী করেন গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠকরা।  অপপ্রচারের ধরন তুলে ধরে পিনাকী ভট্টাচার্য বলেন, “আরিফ জেবতিক, অমি রহমান পিয়ালদের নিয়ে ভুয়া অ্যাকাউন্ট করে তাদের নামে ধর্মবিদ্বেষী বিভিন্ন পোস্ট দেয়া হচ্ছে। রাজীবের নামে বিভিন্ন অপপ্রচার শুরু হল সে মারা যাওয়ার পর।” অপপ্রচারের বিষয়ে আরিফ জেবতিক বলেন, তাদের এই আন্দোলনের সঙ্গে ধর্মবিরোধিতার কোনো সম্পর্ক নেই, যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধের দাবি রয়েছে তাদের। তার মতে, “অনলাইনে যারা অপপ্রচার চালাচ্ছে তারা হামলা, ভাংচুরে অংশ নেয় না। গণমাধ্যমে অপপ্রচার হলে হামলা ভাংচুর করা হচ্ছে।” আমার দেশ, নয়া দিগন্ত, দৈনিক সংগ্রাম ও দিগন্ত টেলিভিশনের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে গণজাগরণ মঞ্চের। হেফাজতে ইসলামসহ কয়েকটি সংগঠন শাহবাগের আন্দোলনকারীদের ‘ইসলামবিরোধী’ বলে আখ্যায়িত করে আসছে। অপপ্রচার প্রতিরোধে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারকারীদের সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেন সিমু নাসের। সেই সঙ্গে সরকারেরও দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেন আরিফ জেবতিক। গণজাগরণ আন্দোলন নিয়ে কলামনিস্ট ফরহাদ মাজহারের বিভিন্ন বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে আরিফ জেবতিক বলেন, “আমরা এখানে এসেছি বিচার চাইতে, কোনো নিরপেক্ষ জায়গা থেকে আন্দোলন করতে আসিনি, আমরা সবাই ভিকটিম। শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ হলে গণতান্ত্রিক পরিবেশে সেটা মেনে নিতেই হবে। উনি সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তরুণদের চিনছেন বলে বলছেন, আর আমরা উনাকে চিনি প্রতিমুহূর্তেই,” বলেন গণজাগরণ আন্দোলনের বক্তব্য বিভিন্ন টেলিভিশনে আলোচনায় তুলে ধরে ইতোমধ্যে পরিচিতি পাওয়া মারুফ রসুল।

‘যুদ্ধাপরাধীদের’ প্রতিষ্ঠান বর্জন

ইসলামী ব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে জামায়াত সংশ্লিষ্ট হিসেবে চিহ্নিত করে সেগুলো বর্জনের আহ্বান রয়েছে গণজাগরণ মঞ্চের। এ বিষয়ে আন্দোলনকারীদের নেতৃস্থানীয়দের অন্যতম মাহমুদুল হক মুন্সী বলেন, “জাতি পরিশুদ্ধতার মধ্য দিয়ে গেলে বিষবৃক্ষগুলোও পরিস্কার করতে হয়। আমরা চাচ্ছি, নিজেদেরকে সচেতন করে জামায়াত সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো সামাজিকভাবে বয়কট করতে।” ওই প্রতিষ্ঠানগুলোতে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান এবং অনেকের স্বার্থ জড়িত থাকার বিষয়টি আলোচনায় এলে আন্দোলনকারীরা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরকারি নিয়ন্ত্রণে নেয়ার পরামর্শ দেন। আরিক জেবতিক বলেন, “আমরা বলছি, একটি তদন্ত কমিশন গঠন করা হোক।” পিনাকী ভট্টাচার্য বলেন, “তারা জঙ্গি অর্থায়ন করছে। পুলিশের ওপর হামলা, বিভিন্ন স্থানে ভাংচুরে ইসলামী ব্যাংকের অর্থ ব্যবহৃত হচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করা উচিত।” মারুফ রসুল বলেন, “একাত্তরে যারা এদেশের স্বাধীনতা চায়নি, তাদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের টাকা এদেশের উন্নয়নে ব্যয় হবে না।”

আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি

৫ ফেব্রুয়ারি আব্দুল কাদের মোল্লার রায়ের পর শাহবাগে যারা প্রথম প্রতিবাদ জানান, তাদের একজন নাহিদ সুলতানা বলেন, “৫ ফেব্রুয়ারি যে স্থান থেকে আমরা শুরু করেছিলাম, এখনো সেখানেই আছি।” যুদ্ধাপরাধী আব্দুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন সাজার রায় প্রত্যাখ্যান করে গত ৫ ফেব্রুয়ারি শাহবাগে ব্লগারদের এক কর্মসূচি পরে গণজাগরণে পরিণত হয়। এতে যুক্ত হয় ছাত্র সংগঠন ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো।  আন্দোলন একটু স্তিমিত হওয়ার প্রসঙ্গ উঠলে নাহিদ বলেন, “কর্মসূচিতে ভিন্নতা রয়েছে, তবে আমাদের চেতনা এখনো আগের জায়গায়ই আছে।” আন্দোলনের অর্জন কী বলে মনে করেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আন্দোলনের কারণে আইন সংশোধন হয়েছে। এখন আপিলের সুযোগ হয়েছে। “বড় বিষয় হলো জামায়াতকে মরালি (নৈতিক) ভেঙে দেয়া গেছে। তাদের ব্যাকবোন (মেরুদণ্ড) ভেঙে গেছে।”  এই আন্দোলনের মাধ্যমে আদালতে প্রভাবিত করার যো অভিযোগ জামায়াত করছে, সে বিষয়ে পেশায় আইনজীবী নাহিদ বলেন, “কখনোই না, আমরা তো ট্রাইব্যুনালের বিরুদ্ধে দাঁড়াইনি। এখানে জনগণ যেহেতু একটা পক্ষ, আর আমরা যেহেতু জনগণ, তাই আমরা পক্ষ হিসেবে আমরা একটা মতামত দিতেই পারি যে রায়টি আমাদের মনপুত হয়নি।

আন্দোলন কতদিন চলবে- এই বিষয়ে জনপ্রিয় ব্লগার অমি রহমান পিয়াল সরাসরি বলেন, “জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত আমরা ঘরে ফিরব না।” তবে এই আন্দোলনকে কোনো সাংগঠনিক রূপ দেয়ার কোনো পরিকল্পনা নেই বলে জানান মাহমুদুল হক মুন্সী। মারুফ রসুল বলেন, “গণআন্দোলন স্বতঃস্ফূর্তভাবে হয়, এর সাংগঠনিক কাঠামো থাকে না।” আরিফ জেবতিক বলেন, “এটি একটি প্ল্যাটফর্ম, এটা কোনো সংগঠন নয়।” আন্দোলনের মধ্যে অনৈক্য দেখা দিয়েছে বলে যে কথা সম্প্রতি উঠেছে, তা নাকচ করেন সংগঠকরা। আরিফ জেবতিক এই বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলেন, “দ্বিমতের জায়গা আছে, তবে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াটি সচল রয়েছে।” আফসানা কিশোয়ার বলেন, “জাতীয় ইস্যুতে এ আন্দোলন হচ্ছে। ঐক্য কখনোই নষ্ট হবে না।”