ঢাকা : জামায়াতে ইসলামীর ডাকা ৪৮ ঘণ্টা হরতালের প্রথম দিনে আজ রোববার বগুড়া, রাজশাহী, গাজীপুর, জয়পুরহাট, ঝিনাইদহ ও সাতক্ষীরায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছে। এতে পুলিশ, শিশুসহ ২২জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। প্রত্যক্ষদর্শী, পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের বরাত দিয়ে আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর:
বগুড়ায় এগারোজন নিহত
গতকাল শনিবার রাত থেকেই জেলায় গুজব রটে—একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসির দণ্ডাদেশ পাওয়া জামায়াতের নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর চেহারা চাঁদে দেখা যাবে। রাত তিনটার দিকে জেলা শহরের বিভিন্ন মসজিদ থেকে মাইকিং করে সবাইকে বের হয়ে তা দেখার জন্য আহ্বান জানানো হয়। এভাবে জড়ো হয়ে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা ভোর থেকেই মিছিল শুরু করে শহরের বিভিন্ন এলাকায় ভাঙচুর চালাতে থাকেন। সকাল সাতটার দিকে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা শাজাহানপুর থানায় হামলা করেন। বাধা দিতে গেলে পুলিশের সঙ্গে তাঁদের সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। তাঁদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ একপর্যায়ে গুলি ছোড়ে। এতে দুজন নারীসহ পাঁচজন নিহত হন বলে শাজাহানপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নুরুল ইসলাম সংবাদমাধ্যমকে নিশ্চিত করেন। বগুড়ার পুলিশ সুপার (এসপি) মোজাম্মেল হক সংবাদমাধ্যমকে বলেন, থানায় হামলা চালানো হলে পুলিশ আত্মরক্ষার্থে গুলি চালাতে বাধ্য হয়। সকাল সাড়ে সাতটার দিকে জেলা সদরের ইয়াকুবিয়া স্কুলের মোড়ে র্যাবের গাড়িতে হামলা চালায় হরতালের সমর্থকরা। র্যাব বাধা দিলে দুই পক্ষের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। একপর্যায়ে র্যাবের সদস্যরা গুলি চালিয়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করেন। এ সময় চারজন নিহত হন বলে সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সৈয়দ সহিদ আলম নিশ্চিত করেন। শিবগঞ্জ উপজেলার মোকামতলায় পুলিশের সঙ্গে জামায়াত-শিবিরের কর্মীদের সংঘর্ষে দুজন নিহত হয়েছেন বলে পুলিশ জানিয়েছে। এছাড়া জেলা সদর, শাজাহানপুর, নন্দীগ্রাম, দুপচাঁচিয়া ও শিবগঞ্জ উপজেলায় আজ দিনভর তাণ্ডব চালিয়েছেন জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা। তাঁরা কয়েকটি এলাকায় বর্তমান ও সাবেক দুই সাংসদের বাসা, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন কার্যালয়, আওয়ামী লীগের নেতাদের বাড়ি ও দলীয় কার্যালয় ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেন।
রাজশাহীতে শিশুসহ দুজন নিহত
জেলার গোদাগাড়ী উপজেলার মহিষালবাড়ী এলাকায় আজ সকাল সাড়ে নয়টার দিকে জামায়াত-শিবিরের কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। এতে উপজেলার মহিষালবাড়ী এলাকার মোজাহিদ ও হাটপাড়া এলাকার নয় বছরের শিশু রফিকুল ইসলাম নিহত হয়। আহত হন আরও সাতজন। গোদাগাড়ী থানার ওসি অহিদুল ইসলাম সংবাদমাধ্যমকে দুজন নিহত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। গোদাগাড়ীর ইউএনও এস এম তুহিনূর আলম জানান, উপজেলায় আজ থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে।
গাজীপুরে পিকেটিংকালে ট্রাকের চাপায় শিবির নেতা নিহত
জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা আজ সকালে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার জৈনাবাজার এলাকায় পিকেটিং করতে যান। সেখানে নেতা-কর্মীরা রাস্তায় গাছের গুঁড়ি ফেলে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেন। এ সময় একটি ট্রাক গাজীপুরের দিকে যাচ্ছিল। ট্রাকটি ভাঙচুর করতে গেলে ট্রাকের চালক বেপরোয়াভাবে চালাতে শুরু করেন। এতে ট্রাকের নিচে চাপা পড়ে গুরুতর আহত হন শ্রীপুর উপজেলা (দক্ষিণ) শিবিরের সভাপতি আবদুর রাজ্জাক (৩০)। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে তাঁর মৃত্যু হয়। গাজীপুর জেলা জামায়াতের আমির আবুল হাশেম খান বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, নিহত আবদুর রাজ্জাক গাজীপুরের ভাওয়াল বদরে আলম কলেজের সম্মান তৃতীয় বর্ষের ছাত্র।
জয়পুরহাটে সহিংসতায় ছয়জন নিহত
জয়পুরহাট-বগুড়া সড়কের সদর উপজেলার হিচমী এলাকায় সকাল থেকেই জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা গাছের গুঁড়ি ও বিদ্যুতের খুঁটি ফেলে রাস্তা অবরোধ করেন। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ছয়-সাত হাজার মানুষ মিছিল নিয়ে শহরের দিকে আসতে থাকে। এ সময় পল্লী বিদ্যুতের কার্যালয়ের পশ্চিম পাশে তাদের বাধা দেয় র্যাব-পুলিশ। তখন মিছিল থেকে বৃষ্টির মতো ইট-পাটকেল ছুড়তে থাকেন কর্মীরা। একপর্যায়ে জামায়াত-শিবিরের অপর একটি দল পেছন থেকে র্যাব-পুলিশের ওপর আক্রমণ চালায়। এতে পুলিশ সুপার হামিদুল আলমসহ র্যাব-পুলিশের সদস্যরা অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। দুপুর ১২টার দিকে বিজিবির জয়পুরহাট ক্যাম্পের অধিনায়ক লে. কর্নেল খসরু ইসলামের নেতৃত্বে বিজিবির একটি দল ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। এরপর র্যাব-পুলিশ-বিজিবি যৌথভাবে গুলি ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়ে জামায়াত-শিবিরকে ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে। এ সময় গুলিবিদ্ধ নিহত হন পাঁচবিবি উপজেলার আর্জিন্তপুর গ্রামের রাজিব আলীর ছেলে ফরমান আলী (৩০), কাশরা গোবিন্দপুর গ্রামের মফিজ উদ্দীনের ছেলে মহিদুল ইসলাম (৩২), বাঁশখুর গ্রামের মোজাহারুল ইসলামের ছেলে নাসির উদ্দীন (১৬), রহমতপুর গ্রামের আজাহার আলীর ছেলে মজনু মিয়া (২৫), শালাইপুর পুকুরপাড় গুচ্ছগ্রামের আবদুল হাকিম (৩০) ও ধরনজী গ্রামের হেসাব উদ্দিন (৩২)। এ ছাড়া গুলিবিদ্ধ হন আরও প্রায় ২৫ জন। অপরদিকে, পাঁচবিবি উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে জামায়াত-শিবিরের ৮-১০ হাজার নেতা-কর্মী মিছিল করে পাঁচবিবি উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কার্যালয়ে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করেছে। পাঁচবিবি থানার ওসি আহসানুল হক জানান, জামায়াত-শিবিরের মিছিলের একটি অংশ থানার সীমানাপ্রাচীর টপকে থানার ভেতরে দুটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটায়। এ ছাড়া পুলিশ কোয়ার্টারের পিছনে আগুন ধরিয়ে দেয়।
ঝিনাইদহে এক পুলিশ নিহত
আজ বেলা ১১টার দিকে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা হরিণাকুণ্ডু উপজেলা শহরে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। তাঁরা আকস্মিকভাবে দোকানপাট, আওয়ামী লীগ অফিস, কৃষি অফিস, মত্স্য অফিস ও এলজিইডির অফিস ভাঙচুর করেন। জামায়াত-শিবিরের কর্মীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ রাবার বুলেট ও কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে। এতে তাঁরা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে পুলিশকে ধাওয়া করেন। একপর্যায়ে পুলিশ পিছু হটে। এ সময় পুলিশের ওপর জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা সশস্ত্র হামলা চালান। তাঁরা পিটিয়ে ও কুপিয়ে ওমর ফারুক (৩৮) নামের এক পুলিশ কনস্টেবলকে আহত করেন। তাঁকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে গেলে ওসিসহ পুলিশের আরও ১০ জন সদস্য আহত হন। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ঝিনাইদহ থেকে অতিরিক্ত পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে ফাঁকা গুলি ছুড়ে জামায়াত-শিবিরের কর্মীদের ছত্রভঙ্গ করে দেন। এরপর তাঁরা কনস্টেবল ফারুকের মৃতদেহ উদ্ধার করেন। পরে ওমরের মৃতদেহ হরিণাকুণ্ডু উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে নেওয়া হয়। তাঁর বাড়ি সাতক্ষীরায়। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিত্সক জামিলুর রশিদ পুলিশ সদস্য ওমর ফারুকের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তবে জেলা পুলিশ ও হরিণাকুণ্ডু থানার ওসি এ ব্যাপারে কিছু জানাতে চাননি।
সাতক্ষীরায় একজন নিহত
বেলা ১১টার দিকে সদর উপজেলার রইচপুর এলাকায় বিজিবির দুটি টহলযানে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে জামায়াত-শিবির। এ সময় বিজিবির সদস্যরা গুলি ছোড়েন। গুলিতে রইচপুর এলাকার মফেজউদ্দীনের ছেলে মাহবুবর রহমান (৩০) নিহত হন। এ ছাড়া গুলিবিদ্ধ হন নাজির হোসেন (৩০), সোহাগ (১২), জাকির হোসেন (২২) ও ইছানুর আলী (৪৫)। আহত হন বিজিবির তিন সদস্য। ঘটনার পরপরই দিগন্ত টিভির সাতক্ষীরা প্রতিনিধি জিল্লুর রহমান ঘটনাস্থলে গেলে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা তাঁর মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা আরও জানান, ভোররাতে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা সাতক্ষীরা-খুলনা, সাতক্ষীরা-আশাশুনি, সাতক্ষীরা-কালীগঞ্জ, সাতক্ষীরা-যশোর, সাতক্ষীরা-বৈকারি ও সাতক্ষীরা-ছনকা সড়কে গাছের গুঁড়ি ফেলে অবরোধ সৃষ্টি করেন। সকাল ১০টার দিকে সাতক্ষীরা-খুলনা মহাসড়কের গোপীনাথপুর এলাকার সড়ক কেটে দেয় জামায়াত-শিবির। এর ফলে খুলনা ও তালা উপজেলার সঙ্গে সাতক্ষীরা শহরের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এ ছাড়া হরতালের সমর্থকেরা দেবহাটার গাজীরহাটে ও সদরের খানপুরে আওয়ামী লীগের কার্যালয় ভাঙচুর করে। তারা সাতক্ষীরা সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শওকাত হোসেনের মোহনপুর গ্রামের বাড়িতে হামলা চালায়।