ঢাকা: ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখার জন্য ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জিকে জাতি শ্রদ্ধাভরে ও কৃতজ্ঞতায় স্মরণ করবে। জাতীয় ইতিহাসে তার নাম, অবদান স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে বলে উল্লেখ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান। সোমবার রাত ৮টায় বঙ্গভবনে প্রণব মুখার্জির সম্মানে আয়োজিত ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা’ প্রদান অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি এ কথা বলেন।
এসময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার পাশে উপস্থিত ছিলেন। এর আগে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় ভারতীয় রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি বঙ্গভবনে উপস্থিত হয়ে রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমানের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে মিলিত হন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ রাষ্ট্রের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন। ভারতের রাষ্ট্রপতি বঙ্গভবনে আসার পর শুরু হয় ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা’ প্রদান অনুষ্ঠান। শুরুতেই মু্ক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য চিত্র দেখানো হয়। সাইটেশন পড়েন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূঁইঞা। সম্মাননা অনুষ্ঠানে দুই দেশের রাষ্ট্রপতি ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বক্তব্য রাখেন। রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমানের তার শুভেচ্ছা বক্তব্যে বলেন, “আজকের এই মহতী অনুষ্ঠানে আপনাদের সবাইকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। আমি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি অনুষ্ঠানের মধ্যমণি বন্ধুপ্রতীম ভারতের মহামান্য রাষ্ট্রপতি শ্রী প্রণব মুখার্জির প্রতি। আমি স্বাগত জানাচ্ছি, তার পত্মী মাননীয়া শুভ্রা মুখার্জিকে, যিনি জন্মসূত্রে আমাদের দেশের কন্যা।” তিনি বলেন, “১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে আজকের মহান অতিথির (প্রণব মুখার্জি) অসামান্য অবদানের জন্য আজ বাংলাদেশ ‘মু্ক্তিযুদ্ধ সম্মাননা পদক’ প্রদানে তাকে মনোনীত করেছে।” তিনি এসময় বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ১৯৭১ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে বলেন, “আমি এ অনুষ্ঠানে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি- হাজার বছরের শেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে, আমি স্মরণ করছি, ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে এবং সেই সঙ্গে ভারতের সেই সকল বীরসেনা ও সাধারণ নাগরিকদের, যারা আমাদের স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন।” এসময় রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান প্রণব মুখার্জিকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, “হে মহান অতিথি! আপনি আমাদের মু্ক্তিযুদ্ধের সময় অনেক সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে আপনার অবিস্মরণীয় অবদান জাতি কৃতজ্ঞতা ভরে স্মরণ করে থাকে। আমাদের জাতীয় ইতিহাসে আপনার নাম, অমূল্য অবদানের কথা স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ রয়েছে। তাই, আজকের এই সম্মাননা আপনার অবদানের বিনিময়ে নয়, বরং সমগ্র জাতির পক্ষ থেকে সামান্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সবিনয় প্রয়াস মাত্র!” সম্মাননা অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি বিনয়ের সঙ্গে বলেন, “এ সম্মাননা ব্যক্তিগতভাবে গ্রহণ করতে এসে এতে আবারও আপনি (প্রণব মুখার্জি) আমাদের কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করলেন।” মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রণব মুখার্জির অবদানের কথা স্মরণ করে রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান বলেন, “হে মহান অতিথি! একাত্তরে মহান মু্ক্তিযুদ্ধে আপনার সমর্থন ছিল মানবতা ও ন্যায়ের পক্ষে। সে দিন আপনার সহযোগিতা আমাদের অসীম সাহস ও উৎসাহ যুগিয়েছিল। তাই, আমরা গভীর শ্রদ্ধাভরে আপনার অবদানের কথা চিরকাল মনে রাখবো। আপনার এই সফর দু্ই দেশের মধ্যকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় করবে।” এদিকে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার শুভেচ্ছা বক্তব্যে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি ও তার পত্মী শুভ্রা মুখার্জিকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, “বসন্তের এই মনোরম সন্ধ্যায় প্রণব মুখার্জি ও শুভ্রা মুখার্জিকে স্বাগত জানাচ্ছি।” তিনি মুক্তিযুদ্ধে প্রণব মুখার্জির অবদানের কথা শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করে বলেন, “১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রণব মুখার্জি আসামান্য অবদান রাখেন। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বিভিন্ন মহলের বাধা উপেক্ষা করে প্রণব মুখার্জি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দৃঢ় ও সাহসী অবস্থান নেন। তিনি বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্ব জনমত গঠনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন।” প্রধানমন্ত্রী বলেন, “প্রণব মুখার্জি বাংলাদেশের দুঃসময়ের অকৃত্রিম বন্ধু! তার অবদানের কথা বাংলাদেশের মানুষ চিরকাল কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করবে।” ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি শুভেচ্ছা বক্তব্যে বলেন, “সম্মাননা প্রদানের জন্য আমি আপনাদের শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ জানাচ্ছি। যদিও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আমার অবদান ছিল যৎসামান্যই! তার পরও আমি বিনম্র চিত্তে এ সম্মাননা গ্রহণ করছি।” তিনি বলেন, “বাংলাদেশের যে কোনো প্রয়োজনে ভারত পাশে থাকবে। ভারত চায়, বাংলাদেশে গণতন্ত্র অব্যাহত থাকুক। ভারত দ্বিপাক্ষিক ও আঞ্চলিক উন্নয়নে বিশ্বাসী। সে হিসেবে বাংলাদেশের উন্নতি ও সমৃদ্ধি কামনা করে ভারত।” তিনি এসময় বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা জানিয়ে মু্ক্তিযুদ্ধের স্লোগান উচ্চারণ করে তিনি বলেন, “যতদিন রবে পদ্মা-মেঘনা-যমুনা বহমান, ততদিন রবে তোমার কীর্তি শেখ মুজিবুর রহমান।” অপরদিকে, কর্মসূচি অনুযায়ী রাতে বঙ্গভবনের ব্যাঙ্কুয়েট হলে রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান আয়োজিত রাষ্ট্রীয় ভোজসভায় অংশ নেবেন ভারতের রাষ্ট্রপতি ও ফার্স্ট লেডি শুভ্রা মুখোপাধ্যায়। আগামীকাল মঙ্গলবার সফরের শেষদিন। এ দিন সকাল ৯টায় ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট রেলস্টেশনে যাবেন ভারতের রাষ্ট্রপতি। সেখানে পতাকা উড়িয়ে ভারতীয় ঋণে কেনা ট্রেনের ইঞ্জিন ও ওয়াগন উদ্বোধন করবেন। এর পর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ভিভিআইপি টারমাক থেকে হেলিকপ্টারে করে রওয়ানা হবেন শ্বশুরের আদিনিবাস নড়াইলের উদ্দেশে। ফার্স্ট লেডি এ সময় তার সঙ্গে উপস্থিত থাকবেন। নড়াইলের ভদ্রবিলায় মন্দির পরিদর্শন ও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন প্রণব মুখার্জি। পরে নড়াইল থেকে কুষ্টিয়ার শিলাইদহে যাবেন। সেখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠিবাড়ি পরিদর্শন ও চারা রোপন করবেন তিনি। দুপুর দেড়টায় নড়াইল থেকে যাবেন টাঙ্গাইলের ভারতেশ্বরী হোমসে। সেখানে কুমুদিনী কমপ্লেক্সে কুমুদিনী লাইব্রেরি, কুমুদিনী হাসপাতাল পরিদর্শন করবেন ভারতের রাষ্ট্রপতি। ভারতেশ্বরী হোমস পরিদর্শন এবং সেখানকার ছাত্রীদের অংশগ্রহণে ডিসপ্লেও উপভোগ করবেন প্রণব মুখার্জি। মধ্যাহ্নভোজের পর তিনি ও তার সফরসঙ্গীরা টাঙ্গাইল থেকে সরাসরি হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আসবেন। এসময় দুই দেশের প্রতিনিধিদলের শুভেচ্ছা বিনিময় শেষে বিকেল সাড়ে ৪টায় ঢাকা ছাড়বেন তিনি। বিমানবন্দরে ভারতের রাষ্ট্রপতিকে বিদায় জানাবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, প্রণব মুখোপাধ্যায়কে পাঞ্জাবি ও ফার্স্টলেডি শুভ্রা মুখোপাধ্যায়কে শাড়ি উপহার দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ ছাড়া প্রণব পরিবারের সদস্যদের জন্যও উপহার থাকছে। রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমানও তাদের উপহার সামগ্রী দেবেন বলে জানা গেছে। প্রসঙ্গত, প্রায় চার দশক পর ভারতের কোনো রাষ্ট্রপতি ঢাকায় আসলেন। এর আগে ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে এসেছিলেন ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি। প্রণব মুখার্জি এমন এক সময় বাংলাদেশ সফর করছেন, যখন একাত্তরের মানবতাবিরোধীদের বিচারকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে ব্যাপক সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ সফরকালে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে অবস্থানকালে সোমবার দুপুরে এর সামনের রাস্তায় ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। জামায়াতের ডাকা দ্বিতীয় দিন ছিল সোমবার। প্রশাসনসহ সবার ধারণা, আতঙ্ক সৃষ্টি করার জন্যই জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরাই এ ঘটনা ঘটিয়েছে।