ঢাকা: সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়া পাঁচটি অভিযোগের ওপর ভিত্তি করেই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন রায়ের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তির আর্জি নিয়ে আপিল করেছেন প্রসিকিউশন (রাষ্ট্রপক্ষ)। রোববার সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে এ আপিল (আপিল নম্বর: ২৪/২০১৩) করা হয়।
আপিলের সঙ্গে দুই খণ্ডে ৪৮৪ পৃষ্ঠার পেপারবুক ও সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র জমা দেওয়া হয়েছে। বেলা ১২টা ২৫ মিনিটে আপিল ফাইলটি আদালতে দাখিল করেন সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড মধুমালতী চৌধুরী বড়ুয়া। এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সমন্বয়ক ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমান, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল একরামুল হক টুটুল, ট্রাইব্যুনালের রাষ্ট্রপক্ষের চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু উপস্থিত ছিলেন। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আপিল শুনানিতে সরকারপক্ষে নেতৃত্ব দেবেন। তাকে সহায়তা করবেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সমন্বয়ক ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমান, সাবেক বিচারপতি সৈয়দ আমীরুল ইসলামসহ প্রসিকিউশনের একটি টিম। গত ৫ ফেব্রুয়ারি মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লাকে দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। ট্রাইব্যুনাল তাকে ৫টি অপরাধে দায়ী করলেও সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসির দণ্ডাদেশ না দেওয়ায় এবং একটি অপরাধের অভিযোগ থেকে খালাস দেওয়ায় সাজা বাড়ানোর লক্ষ্যে এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন প্রসিকিউশন। আপিল দায়েরের পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সমন্বয়ক ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমান সাংবাদিকদের জানান, “কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মোট ৫টি অভিযোগ সন্দোহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। ট্রাইব্যুনালের রায়ে বিস্তারিত বর্ণনা আছে। ট্রাইব্যুনাল রায়ে যেসব অভিযোগের ওপর ভিত্তি করে দোষী সাব্যস্ত করেছেন, সেগুলো উল্লেখ করেই আপিল করা হয়েছে।” বলেন, ‘‘সরকারের তরফ থেকে অপর্যাপ্ত সাজার বিরুদ্ধে আপিল করা হয়েছে। আইন অনুযায়ী আপিল বিভাগে ৬০ দিনের মধ্যে এ আপিল নিষ্পত্তি হবে বলে আশা করছি।’’ এম কে রহমান বলেন, ‘‘সোমবার আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতির কাছে শুনানির সময় নির্ধারণের জন্য আবেদন করা হবে।’’ কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ছয়টি অভিযোগ আনা হয়েছিল। এর মধ্যে ৫টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে এবং একটি রাষ্ট্রপক্ষ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পারেননি বলে রায়ে উল্লেখ করেন ট্রাইব্যুনাল। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় অভিযোগে কাদের মোল্লার ১৫ বছর করে কারাদণ্ড হয়েছে। চতুর্থ অভিযোগ থেকে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। পঞ্চম ও ষষ্ঠ অভিযোগে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে প্রমাণিত অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রথম অভিযোগ, একাত্তরের ৫ এপ্রিল মিরপুর বাঙলা কলেজের ছাত্র পল্লবকে গুলি করে হত্যার নির্দেশ দেন কাদের মোল্লা। দ্বিতীয় অভিযোগ, একাত্তরের ২৭ মার্চ কাদের মোল্লা সহযোগীদের নিয়ে কবি মেহেরুননিসা, তার মা এবং দুই ভাইকে মিরপুর ৬ নম্বর সেকশনের বাসায় গিয়ে হত্যা করেন। প্রমাণিত তৃতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ২৯ মার্চ বিকেলে সাংবাদিক খন্দকার আবু তালেবকে আরামবাগ থেকে কাদের মোল্লা ও তার সহযোগীরা জল্লাদখানা পাম্পহাউসে নিয়ে জবাই করে হত্যা করেন। পঞ্চম অভিযোগ অনুসারে, একাত্তরের ২৪ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনা ও অবাঙালি রাজাকারদের সঙ্গে কাদের মোল্লা মিরপুরের আলোকদী (আলুব্দী) গ্রামে হামলা চালান। ওই ঘটনায় ৩৪৪ জনের বেশি নিহত হন। ষষ্ঠ অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ২৬ মার্চ কাদের মোল্লা, তার সহযোগী এবং পাকিস্তানি সেনারা মিরপুরের ১২ নম্বর সেকশনে হযরত আলী লস্করের বাসায় যান। কাদের মোল্লার নির্দেশে হযরত, তার স্ত্রী, দুই মেয়ে এবং দুই বছরের এক ছেলেকে হত্যা করা হয়, ধর্ষণের শিকার হন এক মেয়ে। তবে ট্রাইব্যুনাল তার রায়ে বলেছেন, ঘটনা ঘটলেও কেরাণীগঞ্জের ঘাটারচর গণহত্যার সঙ্গে কাদের মোল্লার সংশ্লিষ্টতা সন্দোতীতভাবে প্রমাণ করতে পারেননি রাষ্ট্রপক্ষ। এ অভিযোগ আনা হয়েছিল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে চতুর্থ অভিযোগে। এ অভিযোগ অনুসারে, ২৫ নভেম্বর কাদের মোল্লা ও ৬০-৭০ জন রাজাকার কেরানীগঞ্জ থানার ভাওয়াল খানবাড়ি এবং ঘাটারচরে (শহীদনগর) শতাধিক নিরস্ত্র গ্রামবাসীকে হত্যা করেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন’১৯৭৩ এর বিধান অনুসারে রায় ঘোষণার এক মাস অর্থাৎ ৩০ দিনের মধ্যে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা যাবে। সে হিসেবে কাদের মোল্লার রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার শেষ দিন আগামী মঙ্গলবার ৫ মার্চ। এর দু’দিন আগেই আপিল করলেন রাষ্ট্রপক্ষ। আর সোমবার আসামিপক্ষ আপিল করবেন এ রায়ের বিরুদ্ধে। কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে প্রমাণিত ৫টি অভিযোগের প্রত্যেকটিতে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া সাজা বাতিল করে খালাসের আবেদন করবেন তারা। তবে ইতিপূর্বে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইনে রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আপিলের বিধান ছিল না। শুধু যে কোনো খালাসের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারতেন প্রসিকিউশন। আইনের এ অসামঞ্জস্যতা দূর করতে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে পাস করা হয় ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইবুনালস) (অ্যামেন্ডমেন্ট) বিল-২০১৩’। এর ফলে বাদী-বিবাদী ছাড়াও সরকারও রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবে। ১৮ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপতি এ বিলের অনুমোদন দেওয়ায় তা আইনে পরিণত হয়েছে।