সোমবার, ২০ মে, ২০১৩

তাহেরের মৃত্যুদণ্ডকে ঠাণ্ডা মাথার খুন হিসেবে চিত্রিত করার নির্দেশ

নিউজ ডেস্ক : বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল (অব.) এম এ তাহের বীর উত্তমসহ অন্যদের গোপন বিচার, সাজা কার্যকর এবং বিচারের জন্য ১৯৭৬ সালের ১৬ নম্বর সামরিক আইন আদেশের মাধ্যমে সামরিক ট্রাইব্যুনাল গঠনকে অবৈধ ঘোষণা করে দেওয়া হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়েছে। রায়ে হাইকোর্ট কর্নেল তাহেরের মৃত্যুদণ্ডকে ঠান্ডা মাথার খুন হিসেবে চিত্রিত করার জন্য সরকারের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন।
সোমবার বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দীন চৌধুরী ও বিচারপতি শেখ মোঃ জাকির হোসেন এ রায়ে সাক্ষর করেছেন বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমান। বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল (অব.) এম এ তাহের বীর উত্তমসহ অন্যদের গোপন বিচার, সাজা কার্যকর এবং বিচারের জন্য ১৯৭৬ সালের ১৬ নম্বর সামরিক আইন আদেশের মাধ্যমে সামরিক ট্রাইব্যুনাল গঠনকে অবৈধ ঘোষণা করে ২০১১ সালের ২২ মার্চ রায় দেন হাইকোর্ট। রায়ের অভিমতে বলা হয়, “ট্রাইব্যুনাল গঠনের অনেক আগেই জেনারেল জিয়াউর রহমান কর্নেল তাহেরের মৃত্যুদণ্ড প্রদানে মনস্থির করেন।” রায়ে আদালত বলেন, “যেহেতু জেনারেল জিয়াউর রহমান জীবিত নেই, আইন অনুযায়ী তার বিচার সম্ভব  নয়। কিন্তু তারপরও সরকারের উচিত হবে, এই হত্যার জন্য দায়ী কেউ জীবিত থাকলে তাকে খুঁজে বের করে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত করা।” ১৯৮ পৃষ্ঠার রায়ে আদালত বিভিন্ন ঐতিহাসিক দিকও তুলে ধরেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থান চলে। এরই এক পর্যায়ে জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা গ্রহণের পর ১৯৭৬ সালের ১৭ জুলাই তাহেরসহ ১৭ জনকে সামরিক ট্রাইব্যুনালে গোপন বিচারের মাধ্যমে সাজা দেওয়া হয়। এর চার দিন পর ২১ জুলাই ভোররাতে তাহেরের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। ২০১০ সালের ২৩ আগস্ট কর্নেল তাহেরের স্ত্রী লুৎফা তাহের, ভাই ফ্লাইট সার্জেন্ট আবু ইউসুফ খান বীর বিক্রমের স্ত্রী ফাতেমা ইউসুফ ও অপর ভাই ড. আনোয়ার হোসেন ওই বিচার চ্যালেঞ্জ করে প্রথম রিটটি করেন। এসব রিটের দীর্ঘ শুনানির পর আদালত রায়ে সামরিক শাসন, সামরিক আদালত, এবং কর্ণেল তাহেরসহ নয়জনের দণ্ডাদেশকে অবৈধ ঘোষণা করেন।

এছাড়াও আদালত মেজর জিয়াউদ্দিন, কর্পোরাল শামসুল হক, হাবিলদার আব্দুল হাই মজুমদার ও মো. আব্দুল মজিদকে সামরিক বাহিনী থেকে বরখাস্তের আদেশকে অবৈধ ঘোষণা করে তারা পূর্ণ মেয়াদে চাকরিতে বহাল ছিলেন বলে গণ্য করার নির্দেশ দেন। তাদের সমস্ত বকেয়া বেতন, পেনশনসহ অন্যান্য সুবিধাদি ও পদোন্নতির বিষয় বিবেচনা করার জন্য সরকারকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। রায়ে দণ্ডিতের তালিকা থেকে রিটকারীদের নাম মুছে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আদালত রায়ে বলেন, “যেদিন সামরিক বিধি জারি করা হয়েছে তার পরদিনই ট্রাইব্যুনাল তথাকথিত বিচারকার্য শুরু করে। ” মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফশুজের সাক্ষ্য ও বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের বইয়ের লেখা এ রায়ে বিবেচনা করা হয়। এ প্রসঙ্গে আদালত বলেন, “ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ তার ‘ডেমোক্রেসি অ্যান্ড চ্যালেঞ্জ অব ডেভেলপমেন্ট: এ স্টাডি অব পলিটিক্যাল অ্যান্ড মিলিটারি ইন্টারভেনশান ইন বাংলাদেশ’ বইয়ে লিখেছেন, এই বিচারের ট্রাইব্যুনাল গঠনের অনেক আগেই জেনারেল জিয়াউর রহমান পাকিস্তান ফেরত সামরিক অফিসারদের তুষ্ট করতে কর্নেল তাহেরকে ফাঁসি দেওয়ার মনস্থির করেছিলেন। জেনারেল মঞ্জুরের উদ্ধৃতি দিয়ে মার্কিন সাংবাদিক লিফশুজও একই বক্তব্য দিয়েছেন।” এছাড়াও তৎকালীন ঢাকা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ড. এমএম শওকত আলী এবং সাহিত্যিক সাংবাদিক সৈয়দ বদরুল আহসানের লিখিত দাবিসহ অ্যামিকাস কিউরি জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের মতামতের ভিত্তিতে আদালত এ সিদ্ধান্তে আসেন যে, “কর্নেল তাহের বীর উত্তমের মৃত্যুর মুল আসামি জেনারেল জিয়াউর রহমান।”

রায়ে বলা হয়, “যে অপরাধে কর্নেল তাহেরকে অভিযুক্ত করা হয়েছিলো সেই অপরাধে মৃত্যুদণ্ডের কোনো বিধান ছিল না। বরং সর্বোচ্চ দশ বছরের কারাদণ্ডের বিধান ছিল।” রায়ে আরো বলা হয়, “বিচার হয়েছে জেলখানার অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। ট্রাইব্যুনালের অন্য সদস্যের সামনে কোনো নথি উপস্থাপিত হয়নি। অপরাধ আমলে নেওয়ার বিধান ছিলো না। মোট কথা একটি ফৌজদারি মামলায় সকল প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি।” রিটের পক্ষে ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ, ড. শাহদীন মালিক প্রমূখ, রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমান এবং অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে ড. কামাল হোসেন, ড. এম জহির, ব্যারিস্টার এম আমীর উল ইসলাম, অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন, অ্যাডভোকেট এ এফ এম মেজবাউদ্দিন আহমেদ, অ্যাডভোকেট আকতার ইমাম, অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না, অ্যাডভোকেট এম আই ফারুকী ও অ্যাডভোকেট আবদুল মতিন খসরু শুনানি পরিচালনা করেন।

২০১০ সালের ২৩ আগস্ট কর্নেল তাহেরের স্ত্রী লুৎফা তাহের, ভাই ফ্লাইট সার্জেন্ট আবু ইউসুফ খান বীর বিক্রমের স্ত্রী ফাতেমা ইউসুফ ও অপর ভাই ড. আনোয়ার হোসেন গোপন বিচার চ্যালেঞ্জ করে প্রথম রিটটি করেন। ‘এই আইন এবং আইনের অধীনে গঠিত বিশেষ সামরিক ট্রাইব্যুনাল ও প্রথম মামলার রায়কে কেন বেআইনি ও সংবিধান পরিপন্থী ঘোষণা করা হবে না’ তার কারণ জানতে চেয়ে ওই দিন রুল জারি করেন হাইকোর্ট। পরে ২০১১ সালের ২৪ জানুয়ারি কর্নেল তাহেরের সঙ্গে দণ্ডিত জাসদ সভাপতি বর্তমান তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু এমপি ও কেন্দ্রীয় নেতা রবিউল আলম আরো একটি রিট করেন। এছাড়া একই বছরের ৩১ জানুয়ারি ওই গোপন আদালতে দণ্ডিত মেজর (অব.) জিয়াউদ্দিন, কর্পোরাল শামসুল হক ও আবদুল হাই মজুমদার বাদী হয়ে একটি এবং এরপর দিন আবদুল মজিদ বাদী হয়ে আরও একটি রিট হাইকোর্টে দাখিল করেন। চারটি রিটের শুনানি শেষে ২০১১ সালের ২২ মার্চ এক সঙ্গে এ রায় দেওয়া হয়।