প্রেসক্লাব থেকে: হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবি সংবিধান বহির্ভূত মন্তব্য করে তা প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছেন নারী নেত্রীরা। একই সঙ্গে ১৩ দফাকে রুখতে রাজপথেও থাকবেন বলে জানিয়েছেন তারা। সমাবেশে বক্তারা নারী অধিকার রক্ষায় সরকারের উদ্দেশ্যে পেশ করেছেন ১০ দফা দাবি। শনিবার বিকেলে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে প্রতিবাদী নারী সমাবেশ থেকে এসব দাবি জানানো হয়।
এসময় বক্তারা বলেন, “হেফাজতের ১৩ দফা মানি না, যে কোনো মূল্যেই আমরা তা রুখবো। মুষ্টিমেয় সাম্প্রদায়িক সংগঠন, দল ও ব্যক্তি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে নারী অধিকার খর্ব করার জন্য ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। তারা নারী অধিকার ও অবস্থান সম্পর্কে অপপ্রচার চালাচ্ছে, যা সংবিধান পরিপন্থী।”দশ দফা দাবি তুলে ধরে তারা আরও বলেন, “দেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সব গণতান্ত্রিক-প্রগতিশীল-মানবাধিকার ও উন্নয়ন সংগঠন ছাত্র-যুব-শ্রমিক পেশাজীবী নির্বিশেষে সব নারী-পুরুষের পক্ষে সরকারের কাছে আমাদের দাবি জানাচ্ছি।” তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সুলতানা কামাল বলেন, “হেফাজতে ইসলাম তাদের রণকৌশল হিসেবে ধর্মকে ব্যবহার করে নারীদের আক্রমণ করছে।” তিনি বর্তমান সরকারের উদ্দেশ্যে বলেন, “সরকার ৭২ এর সংবিধানে ফিরে যাবেন বলে জনগণের কাছে অঙ্গিকার করে ক্ষমতায় এসেছিল। কিন্তু এখনো সে সংবিধানে ফিরে যায়নি। এখনও ইসলাম ধর্মকে সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম রেখেছে।”
নারী নেত্রী খুশি কবির বলেন, “আমাদের জন্ম নারীর গর্ভে। কাজেই যে গর্ভে আমাদের জন্ম তাদের বিরুদ্ধে কোনো বিবেকবান মানুষ দাঁড়াতে পারে না।” তিনি বলেন, “আমরা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ চাই। সম অধিকারের ভিত্তিতে বাঁচতে চাই। সংবিধানে ধর্ম-বর্ণ অনুযায়ী সম অধিকার। আমরা নারীরা সম-অধিকারের জন্য লড়াই করছি। আমরা আমাদের দাবি আদায় না করে মাঠ ছাড়বো না।” সমাবেশে একাত্মতা জানাতে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, “বাংলাদেশের একটি চেতনা তা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই থাকবে। সে চেতনার বাইরে আর কোনো কিছু থাকতে পারেনা।” হেফাজতের ১৩ দফা অসাংবিধানিক বলেও মন্তব্য করেন তিনি। তিনি বলেন, “বাংলাদেশের সংবিধান গণতান্ত্রিক সংবিধান। এখানে নারী পুরুষের কোনো বিভাজন নেই। নারী পুরুষের সমতার ভিত্তিতে এ দেশ চলবে।”
নারী নেত্রী এবং সমাবেশের সভাপতি আয়শা খানম বলেন, “নারীদের বিরুদ্ধে সব ষড়যন্ত্রের জবাব দিতে আমরা একশ’র বেশি নারী সংগঠন সমবেত হয়েছি। আমাদের রক্ত প্রীতিলতার রক্ত। এদেশের নারীর রক্ত আন্দোলনকারীর রক্ত।” তিনি বলেন, “উপনিবেশবাদ থেকে শুরু করে গণতন্ত্র রক্ষার আন্দোলন পর্যন্ত সব আন্দোলনে নারীরা অংশ নিয়েছে, আন্দোলন করেছে। রক্তের বিনিময়ে যে শাসনতন্ত্র আমরা অর্জন করেছিলাম সেখানে নারী-পুরুষের সমতার কথা বলা হয়েছে। সেখানে ১৩ দফা নামে এই নতুন আগাছা থাকতে পারে না।” এই নারী নেত্রী আরও বলেন, “বাংলাদেশের নারীরা ঘরে বসে থাকবে না, ওয়াসফিয়া-নিশাত বাংলাদেশের নারীদের অন্য উচ্চতায় তুলে ধরেছে। ২১ শতকের বাংলাদেশ কেবল সামনের দিকে এগিয়ে যাবে, পেছনে নয়।” তিনি আরও বলেন, “অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের জন্য যখন একটি ঐতিহাসিক দায় মুক্তি ঘটছে, মানবতাবিরোধী রাজাকারদের বিচার হচ্ছে, তখন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে এদের সমর্থন দিচ্ছে একটি রাজনৈতিক দল। এরও জবাব দেওয়া হবে।” হেফাজতিরা ১৩ দাবি আমাদের চাপিয়ে দিতে চায়। তারা বাংলাদেশকে পাকিস্তান, আফগানিস্তান বানাতে চায় বলেও মন্তব্য করেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. গীতি আরা নাসরিন বলেন, “আজ থেকে একশ বছর আগে বেগম রোকেয়া নারী শিক্ষার জন্য কাজ করেছেন। নারীদের সব ধর্মীয় গোড়ামীর ঊর্দ্ধে নেওয়ার জন্য লড়াই করেছেন। একশ বছর পরেও দেখছি নারীদের শিক্ষা বঞ্চিত করার চেষ্টা এখনও অব্যাহত। যারা এ কাজ করছে তারা মৌলবাদী।”
তিনি বলেন, “মৌলবাদীদের ধরন বিভিন্ন প্রকার হতে পারে। যারা নারী শ্রমিকদের নায্য বেতন দেয় না, যারা নারী নীতির বিরুদ্ধে কথা বলে, যারা যৌতুক, শিশু-নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে কথা বলে না তারা সবাই এক এক প্রকারের মৌলবাদী। এদের হাত থেকে এদেশের মানুষকে রক্ষা করতে হবে।” সংস্কৃতিকর্মী মিতা হক বলেন, “পৃথিবীতে বাংলাদেশ ছাড়া এমন একটি রাষ্ট্র নেই যেখানকার মানুষ দু’ভাবে বিভক্ত। যার একটি পক্ষ দেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে এবং অন্য পক্ষ করে না। এর জন্য জাতি হিসেবে আমরা লজ্জিত।” তিনি বলেন, “ধর্মের দোহাই দিয়ে দেশ এ বছর যা শুরু হয়েছে তাতে সব রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় সংগঠনের ভূমিকা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। দেখলেই বোঝা যায় কারা বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করে, কারা করে না। যারা বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করে না, নারী সমাজকে পিছিয়ে রাখতে চায় তাদের এখনই ছুড়ে ফেলতে হবে। সেটা নিজের শরীরের অংশ হলেও তাদের আমরা কেটে ফেলব।” আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ বলেন, “নারীরা ইসলামের প্রচার করেছে। ইসলামে নারী ও পুরুষের সম অধিকার নিশ্চিত করেছে। ধর্মে কোথাও নারীকে ছোট করা হয়নি। ছোট করেছে হেফাজতে ইসলাম।” তিনি বলেন, “ইসলাম রক্ষার নামে একাত্তরে নির্যাতন করেছে আলবদর রাজাকাররা আর স্বাধীনতার ৪২ বছর পরে এখন তাদের দোসর হেফাজতে ইসলাম তাণ্ডব চালাচ্ছে। ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে ধর্ম সম্পর্কে অপপ্রচার করছে।” শ্রমিক নেত্রী নাজমা আক্তার বলেন, “রেশমার মতো শ্রমিকরাই বাংলাদেশ গড়ে। হেফাজতরা নয়। অর্থনৈতিক মুক্তিসহ সব আন্দোলনে গতি আনে নারীরা।”
সাংবাদিক নাসিমুন আরা হক মিনু বলেন, “বাংলাদেশের প্রধান দু’দলের নেতৃত্বে দিচ্ছেন নারী। রাস্তা পরিচ্ছন্ন থেকে শুরু করে আমাদের নারীরা দেশ পরিচালনা এবং পর্বত আরোহন পর্যন্ত করেছেন। প্রতিটি চ্যালেঞ্জিং পেশায় নারী। সবক্ষেত্রেই নারীদের সফলতার চিহ্ন রয়েছে।” তিনি বলেন, “নারীদের দমন করা মানে এখন মধ্যযুগে ফিরে যাওয়া।” নারী নেত্রী রেবেকা সরন বলেন, “হেফাজতে ইসলাম নারীদের অবরুদ্ধ করে রাখতে চায়। নারীরা প্রতিটি আন্দোলনে দেখিয়েছে তারা পিছিয়ে থাকার নয়।” নারী নেত্রী রোকেয়া কবির বলেন, “এদেশের একজন নারীও রাজাকার, আলবদর, আল শামস ছিল না। নারীরা এ দেশকে এগিয়ে নিয়ে গেছে প্রতিটি ক্ষেত্রে। যারা নারীদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করবে তাদের এদেশ থেকে উৎখাত করবে জনগণ।” সমাবেশে সংহতি জানান গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ডা. ইমরান এইচ সরকার। তিনি বলেন, “আমরা যখন প্রজন্ম চত্বরে নারীর সম অধিকার ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের জন্য আন্দোলন করছিলাম। তখন হেফাজতিরা নারীদের ঘরে বন্দি করতে ১৩ দফা দাবি নিয়ে মাঠে নেমেছে। তাদের দাবিগুলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও সংবিধান পরিপন্থী।” ইমরান বলেন, “বাংলাদেশ পরিপন্থী এসব দাবি নিয়ে তাদের কর্মসূচি পালন করতে দেওয়ার কথা নয়। এরপরও তারা অবরোধের নামে ব্যাপক নৈরাজ্যের সৃষ্টি করেছে।” তিনি আরও বলেন, “আমরা ভেবেই পাই না। তারা রাজপথে নামার সাহস পায় কোথায়। কীভাবে তারা মাঠে নামতে পারে। এদের প্রতিহত করতে নারী-পুরুষ সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে নামতে হবে।”
সমাবেশে সংহতি জানান, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল, সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি তারানা হালিম এমপি, কথা সাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক, সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, তথ্য কমিশনার সাদেকা হালিম, নারী নেত্রী মোশরেফা মিশু, বিচারপতি কে এম সোবহান প্রমুখ। এছাড়া সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, গণজাগরণ মঞ্চ, সচেতন নারী সমাজ, বঙ্গবন্ধু প্রজন্ম লীগ, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, রুমী স্কোয়াড, মহিলা আওয়ামী লীগ, ঢাকা সিটি মহিলা কলেজ, নারী কমিউনিটি মতিঝিল, যুব মৈত্রী, ছাত্র মৈত্রী, যুব মহিলা লীগ, লালমাটিয়া কলেজ, ইডেন কলেজ, বঙ্গবন্ধু মহিলা পরিষদ, আওয়ামী মহিলা আইনজীবী সমিতি, বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশন, বুলবুল ললিতকলা একাডেমিসহ বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও পেশাজীবী সংগঠন এ সমাবেশে সংহতি জানান। সমাবেশে বক্তব্যের শেষে সাভার ভবন ধসে নিহতদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।