ঢাকা, ২১ জানুয়ারী : ডিজেল, কেরোসিনসহ সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার ধকল কাটিয়ে না উঠতেই জনগণকে গুনতে হবে বিদ্যুতের অতিরিক্ত মূল্য। চলতি সপ্তাহের যেকোনো দিন আসছে বিদ্যুতের দাম বাড়ার ঘোষণা। এ নিয়ে সপ্তমবারের মতো খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়াচ্ছে মহাজোট সরকার। নতুন এই দাম কার্যকর হচ্ছে ১ জানুয়ারি থেকেই। দাম বাড়ানোর বিষয়টি নিশ্চিত করেছে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। তবে বিদ্যুতের দাম তিন বা সাড়ে তিন শতাংশের বেশি বাড়ানো হবে না বলেও জানায় বিইআরসি।
এ ব্যাপারে বিইআরসির সদস্য ড. সেলিম মাহমুদ বলেন, "এই সপ্তাহের যেকোনো দিন নতুন মূল্য তালিকা ঘোষণা করতে পারে কমিশন। তবে এই মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না কত শতাংশ বৃদ্ধি করা হচ্ছে।"সেলিম মাহমুদ আরো বলেন, "বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় এবং পাইকারি ও খুচরা দামের মধ্যে ব্যবধান বেশি থাকায় বিপণন কোম্পানিগুলো প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। তাই এই মুহূর্তে আরেক ধাপ বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন।"
ভোক্তাদের স্বার্থের কথা চিন্তা করেই দাম বাড়ানা হচ্ছে দাবি করে সেলিম মাহমুদ বলেন, "কমিশন স্বাধীনভাবেই কাজ করছে। কমিশনের আইন অনুযায়ী ভোক্তা পর্যায়ের গণশুনানি নেয়ার পরই দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।' পুরো বিষয়টি একটি বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হচ্ছে বলে জানান তিনি।
আর্থিক লোকসানের দোহায় দিয়ে পাঁচ মাসের মাথায় আরেক দফা দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেয় বিপণন কোম্পানিগুলো। ইতিমধ্যে দেশের পাঁচটি বিপণন কোম্পানির দাম বাড়ানোর প্রস্তাবের ওপর গণশুনানি শেষ করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)।
তবে বিপণন কোম্পানিগুলোর আর্থিক ক্ষতির বিপরীতে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্তকে যৌক্তিক মনে করছেন না বিশেষজ্ঞ ও ব্যবসায়ী মহল। তাদের মতে, যদি কোম্পানিগুলোর আর্থিক লোকসান থাকে, তাহলে অন্য কোনো খাতে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বসিয়েও ক্ষতি পোষানো সম্ভব। কিন্তু তা না করে বিদ্যুতের দাম বাড়ালে সব উৎপাদনশীল খাতের ব্যয় বেড়ে যাবে, যার প্রভাব পড়বে জনগণের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার ওপর।
গত বছরের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি), ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ওজোপাডিকো), ঢাকা বিদ্যুৎ সরবরাহ কোম্পানি (ডেসকো), ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি (ডিপিডিসি) ও পলস্নী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) দাম বাড়ানোর প্রস্তাবের ওপর গণশুনানি গ্রহন করে বিইআরসি।
শুনানিতে পিডিবির ১২ শতাংশ দাম বাড়ানোর প্রস্তাবের বিপরীতে ৪ দশমিক ৮৪ শতাংশ, ওজোপাডিকোর ৯ দশমিক ৫৯ শতাংশের বিপরীতে ৪ দশমিক ১৫ শতাংশ, ডেসকোর ১১ দশমিক ৬৯ শতাংশের বিপরীতে ৩ দশমিক ৩০ শতাংশ, ডিপিডিসির ১১ দশমিক ৩১ শতাংশের বিপরীতে ৩ দশমিক ৬৫ শতাংশ দাম বাড়ানোর সুপারিশ করে বিইআরসির কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি।
শুনানিতে অংশ নেয় কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব), বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুককারক ও রফতানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) ও বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি।
লোকসান ঠেকাতে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোকে অযৌক্তিক দাবি করেছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ক্যাবের উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম। শামসুল আলম বলেন, "শুধু দাম বাড়িয়ে লোকসান কমানো যায় না। আর এই পদ্ধতি হবে আত্মঘাতী। কিছুদিন আগে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। এর কুফল দাম বাড়ানোর পরদিন থেকেই পাচ্ছে জনগণ। এখন যদি আবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়, তাহলে বিষয়টা হবে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা।"
শামসুল আলম অভিযোগ করেন, "বিদেশি আর্থিক সংস্থাগুলোর মন রক্ষার্থে বিদ্যুতের দাম বাড়াচ্ছে সরকার। বেশ কয়েকটি বিপণন কোম্পানিও ইতিমধ্যে মুনাফা পেতে শুরু করেছে।"
জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিতে বিইআরসির ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন এই জ্বালানি বিশেষজ্ঞ। শামসুল হক বলেন, "এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। কিন্তু তাদের ভূমিকা দেখে মনে হয়, তারা সরকারের আজ্ঞাবহ। কমিশনকে পাশ কাটিয়ে নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে সরকার। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে কমিশনকে প্রতিবাদ করতে দেখলাম না।" বিদ্যুতের দাম না বাড়িয়ে জ্বালানি খাতের কর মওকুফ করে দিলেই লোকসান ঠেকানো যেত বলে মত দেন তিনি।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, "গত বছর শেষের দিকে একবার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে সরকার। তখনই আমরা বলেছি, আমাদের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে, ব্যবসায়ীরা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। কিন্তু সরকার আমাদের কথা শুনেনি। আবার যদি বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয় তাহলে আমাদের ফ্যাক্টরি বন্ধ করে দিয়ে ঘরে বসে থাকতে হবে।"
মহিউদ্দিন আরো বলেন, "নতুন কোনো কারখানা স্থাপনের চিন্তা করতে পারছি না আমরা। আবার কাজের অর্ডার নেয়ার সময় বায়ারদের (বিদেশি ক্রেতা) আমরা যে উৎপাদন খরচ দেখায়, তা বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির কারণে পরে অনেক বেড়ে যায়। ফলে উৎপাদন খরচ বাড়লেও বিক্রয় মূল্য বাড়ে না। এতে বিপুল অর্থের ক্ষতি হয় মালিকদের।"